সালাম মুর্শেদীর পরিবারের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চায় দুদক

সম্পদ অনুসন্ধান শুরু হচ্ছে

** জাল রেকর্ড তৈরি করে দখল করা গুলশানের সেই প্লট দখলের মামলার আসামি হয়েছেন মুর্শেদী
** সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে
** বাফুফের আর্থিক অনিয়মের দায়ে ফিফার শাস্তিও পেয়েছেন এক সময়ের তুখোড় এই খেলোয়াড়

তুখোড় ফুটবলার ছিলেন আব্দুস সালাম মুর্শেদী। ফুটবলের মাঠ ছেড়ে হয়ে যান পাকা ব্যবসায়ী। সম্পদশালী হয়ে নাম লেখান রাজনীতিতে। তবে সাফল্যের বল জালে ঢোকাতে প্রতি ক্ষেত্রেই করেছেন ফাউল। তিনি যেখানেই গেছেন, কৌশলে শীর্ষ পদ বাগিয়েছেন। জড়িয়েছেন একের পর এক কেলেঙ্কারিতে। ব্যবসা ও সম্পদ বাড়াতে ব্যবহার করেছেন সংসদ সদস্যপদ। আওয়ামী লীগের পাঁচ বছরে তার ব্যক্তিগত বৈধ সম্পদই বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। তবে অবৈধ সম্পদ বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) আর্থিক অনিয়মের দায়ে ফিফার শাস্তি, গুলশানের বাড়ি তেলেসমাতির মতো একের পর এক অপকর্ম করেই গেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন।
Salam Morshedi 1

তুখোড় খেলোয়াড় ও ব্যবসায়ী সালাম মুর্শেদীর সহসাই অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে দুদক সালাম মুর্শেদী ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে ৭৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে। আব্দুস সালাম মুর্শেদী ছাড়াও তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে তার স্ত্রী শারমিন সালাম, মেয়ে শেহরিন সালাম, পুত্র ইশমাম সালাম। শুধু অবৈধ সম্পদ নয়, সালাম মুর্শেদী ও তার পরিবারের সদস্যদের অর্থপাচারের অভিযোগও অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন অভিযোগটির অনুসসন্ধান চালাচ্ছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নথি জালিয়াতির মাধ্যমে জাল রেকর্ডপত্র তৈরি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হস্তান্তর, অনুমতি ও নামজারি করে গুলশান-২ আবাসিক এলাকার ১০৪ নম্বর সড়কের ২৭/বি নম্বরে ২৭ কাঠা সরকারি সম্পত্তি আত্মসাত করেন আব্দুস সালাম মুর্শেদী। এই ঘটনায় জড়িত রাজউক কর্মকর্তাদের আসামি করা হলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সালাম মুর্শেদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আসামি তালিকার বাইরে ছিলেন। প্রথম অবস্থায় ক্ষমতার জোরে বেঁচে গেলেও তদন্ত পর্যায়ে আসামি করা হয় সালাম মুর্শেদীকে। সেইসঙ্গে আসামির তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ওই সম্পত্তি দখল করা অপর অংশীদার ইফফাত হক ও তার স্বামী মোহাম্মদ আব্দুল মঈন। এ দম্পতি ২৭ কাঠার মধ্যে ১২ কাঠা দখল করেছিলেন। বাকি ১৫ কাঠা দখল করে বাড়ি নির্মাণ করেন সালাম মুর্শেদী। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর বিশেষ জজ আদালতে এ সংক্রান্ত মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক আনোয়ারুল হক ও উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন ওই মামলাটি তদন্ত করেন।
Salam Morshedi 2
দুদকের একজন সহকারী পরিচালক জানিয়েছেন, আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে সরকারি বাড়ি দখল ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সালাম মুর্শেদী ও তার স্ত্রী, সন্তানদের নামে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে পৃথক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অনুসন্ধান পর্যায়ে তাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে।

খুলনার একাধিক রাজনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় নিজস্ব বলয় তৈরি করেন মুর্শেদী। আওয়ামী লীগের ভেতর তৈরি হয় এমপি লীগ। এমপি থাকাকালে রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়ার ঘাট, পুকুর, জলমহাল, বালুমহালসহ সরকারি সম্পত্তি ছিল মুর্শেদীর অনুসারীদের দখলে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও। রূপসায় কয়েক দফা মুর্শেদী অনুসারীদের হামলায় ঘরছাড়া হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। বিএনপি কর্মীরাও এলাকায় ঢুকতে পারেননি। তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ মানুষ গত ৫ আগস্ট কাস্টমঘাটের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আগুন দেয়। বহু প্রতিভার অধিকারী সালাম মুর্শেদীর জন্ম খুলনার রূপসার নৈহাটি গ্রামে। ১৯৭০ সালে খুলনার ইয়ং বয়েজ ক্লাবের হয়ে ফুটবলজীবন শুরু করেন। এরপর ঢাকায় গিয়ে আজাদ, বিজেএমসি ও ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলে নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যান। ১৯৮৪ সালে তিনি তৈরি পোশাক ব্যবসায় যুক্ত হন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি হন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি ছিলেন। ব্যবসায়ী সমিতির শীর্ষ পদগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং নিজের ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে। নির্বাচনে জালিয়াতি, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে বহুবার।
Salam Morshedi 3
সূত্রমতে, সংসদ সদস্য হয়ে ব্যবসার পাশাপাশি সম্পদ বাড়ানোয় মন দিয়েছিলেন সালাম মুর্শেদী। সংসদ সদস্য হওয়ার পর পাঁচ বছরে আরও ৪৩ কোটি টাকা আয় করেন তিনি। তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ পাঁচ বছরে ১৮ গুণ বেড়েছিল। এমপি থাকাকালে মুর্শেদীর বার্ষিক আয়ও বাড়ে। পাঁচ বছর আগে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এখন তাঁর বার্ষিক আয় আট কোটি দুই লাখ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ রয়েছে, তাঁর হাতে নগদ টাকা রয়েছে ২৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। ব্যাংকে জমা রয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিভিন্ন কোম্পানিতে মুর্শেদীর শেয়ার আছে ৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দামের ভবন। গাড়ি, গৃহ, সম্পত্তি ছাড়াও অন্যান্য অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ২৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকার। ব্যাংকে তাঁর ঋণ আছে ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। মুর্শেদীর স্ত্রীর কাছে ১ কোটি ৮৬ লাখ নগদ টাকা, ব্যাংকে ১৭ লাখ ৭৪ হাজার টাকা এবং ৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকার শেয়ার আছে। অন্যান্য সম্পদ রয়েছে ৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার। ২০১৮ সালে মুর্শেদীর হলফনামায় উল্লেখ ছিল, তাঁর বার্ষিক আয় ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর বার্ষিক আয় ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তাঁর নিজের ৯৫ কোটি ১১ লাখ টাকার, স্ত্রীর ২২ কোটি ৩১ লাখ টাকার এবং নির্ভরশীলের (মেয়ে) ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, ২০০৮ সালে সালাম মুর্শেদী বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ওই গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়াও মুর্শেদী বাফুফের অর্থ কমিটি ও রেফারি কমিটির প্রধানও ছিলেন। দুর্নীতির দায়ে তাকে ২০২৪ সালের ২৪ মে মুর্শেদীকে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ (প্রায় ১৩ লাখ টাকা) জরিমানা করে ফিফা। মূলত বাফুফেতে অনিয়মের কারণেই এই জরিমানা করা হয়। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট বাফুফের সব পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। সর্বশেষ প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে কয়েকজন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ মঞ্জুরের অভিযোগ ওঠে সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে। গত ২৩ জুন দুদক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে এবং মুর্শেদীর ঘনিষ্ঠ চার কর্মকর্তাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। দুদক বিষয়টির তদন্ত করছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!