সামিট পাওয়ারের উৎসে করফাঁকি ১১১২ কোটি টাকা

সিআইসির প্রতিবেদন

** সামিট করপোরেশনের ৬৩.১৯% শেয়ারের মালিক সামিট পাওয়ার লি., কিন্তু লভ্যাংশের উপর উৎসে কর কর্তন করেনি সামিট পাওয়ার
** সামিট করপোরেশনের ৯৯.৯৯% শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লি., কিন্তু লভ্যাংশের উপর এক টাকাও উৎসে কর কর্তন করেনি সামিট করপোরেশন

** তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের চাপে প্রতিষ্ঠানটিকে কর রেয়াত সুবিধা দিতে আইনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে স্পষ্টীকরণ (আদেশ) জারি করতে বাধ্য হন আয়কর কর্মকর্তারা। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) তদন্তে বিধিবহির্ভূতভাবে এই সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

পুঁজিবাজারে বিদ্যুৎ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশের মালিক সামিট করপোরেশন লিমিটেড। আয়কর আইন অনুযায়ী, শেয়ারের হোন্ডিং মালিকদের লভ্যাংশের উপর উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু সামিট পাওয়ার সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন উৎসে কর কর্তনে করেনি। ছয়বছরে উৎসে করফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা।

একইসঙ্গে সামিট করপোরেশনের মোট শেয়ারের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সিঙ্গাপুরের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। আয়কর আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কোন কোম্পানিকে লভ্যাংশ উদ্ভুত হলে তার উপর উৎসে কর কর্তন করতে হয়। কিন্তু সামিট করপোরেশন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ পরিশোধের সময় উৎসে কর কর্তন করেনি। পাঁচ করবছরে এতে উৎসে করফাঁকি দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ সামিট পাওয়ার ও সামিট কপোরেশন মোট উৎসে করফাঁকি দিয়েছে প্রায় এক হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে এই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, বিভিন্ন পন্থায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির বিশেষ অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইসি। সিআইসি বর্তমান সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনা এবং সুনির্দিষ্ট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য কর ফাঁকিবাজদের তালিকা সম্পন্ন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম এবং এদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আয়কর ফাঁকির তথ্য অনুসন্ধানে নেমেছে সংস্থাটি। একইসঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেরও করফাঁকি অনুসন্ধান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সামিট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার লিমিটেডের আয়কর ফাইল অনুসন্ধান করে এই বিপুল পরিমাণ উৎসে করফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামিট পাওয়ার লিমিটেড এর শেয়ারের মধ্যে ৬৩ দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সামিট গ্রুপের আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামিট করপোরেশন লিমিটেড। বাকি ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আয়কর আইন, ২০২৩ এর ১১৭ ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত কোন কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানি লভ্যাংশ প্রদানকালে উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, সামিট পাওয়ার ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে লভ্যাংশের উপর উৎসে কর কর্তন করেছে। কিন্তু সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার উপর উৎসে কর কর্তন করেনি।

অপরদিকে, এনবিআরের ২০১৩ সালের ১ জুলাই জারি করা আদেশ (এসআরও নং-২১১) অনুযায়ী, করদাতা কোম্পানি সামিট পাওয়ার কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে ব্যবসা আয় (উৎপাদনের তারিখ হতে ১৫ বছর পর্যন্ত) এবং কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হতে উদ্ভুত মূলধনী আয় করমুক্ত থাকবে। এছাড়া কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশিদের আয়ের উপর বাংলাদেশে আগমনের তারিখ হতে পরবর্তী তিন বছর, কোম্পানির নেয়া বিদেশি ঋণের উপর প্রদেয় সুদের উপর এবং কোম্পানির প্রদেয় রয়ালিটি, টেকনিক্যাল সেবা ফি এর উপর কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে কোন কর অব্যাহতি নেই। এক্ষেত্রে লভ্যাংশের উপর উৎসে কর দিতে হবে।

অনুসন্ধান বলছে, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সামিট পাওয়ার লিমিটেড ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন ও ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ কর বছর পর্যন্ত (ছয় করবছর)কোম্পানির আয়কর রিটার্ন যাচাই করেছে। এতে দেখা গেছে, সামিট পাওয়ার এই ছয় কর বছরে মোট লভ্যাংশ দিয়েছে এক হাজার ৯৭৫ কোটি ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ৯২১ টাকা। যার উপর প্রযোজ্য উৎসে কর ৩৯৫ কোটি ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮৪ টাকা। মাত্র ৭৬ কোটি ৭৭ লাখ ৪০ হাজার ৫৫৩ টাকা উৎসে কর কর্তন করা হলেও বাকি ৩১৮ ৩৪ লাখ ৫ হাজার ২৩১ টাকা কর্তন করা হয়নি। সুদসহ এই উৎসে করের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ কোটি ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮১৫ টাাক।

অপরদিকে, এনবিআরের আয়কর নীতি উইং থেকে ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ৫৪ ধারা অনুযায়ী, সামিট পাওয়ার ও সামিট করপোরেশন কর্তৃক লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ৫৬(২) ধারা ও আয়কর আইন, ২০২৩ এর ১১৯(২) ধারায় সুবিধাভোগী অংশীদার হিসেবে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে প্রদেয় লভ্যাংশ হতে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না বলে স্পষ্টীকরণ করা হয়েছিলো। এতে বুঝা যায় যে, সামিট পাওয়ার কর্তৃক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে প্রদেয় লভ্যাংশ হতে উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু সামিট পাওয়ার কর্তৃক সামিট পাওয়ার ইন্টান্যাশনালকে কোন লভ্যাংশ প্রদান করা হয়নি। সামিট পাওয়ার সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ প্রদান করা হয়েছে। ফলে আইনের ১১৭ ধারা অনুযায়ী, সামিট পাওয়ার কর্তৃক সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু সামিট পাওয়ার সামিট করপোরেশনকে দেওয়া লভ্যাংশের উপর উৎসে কর কর্তন করেনি। বিষয়টি নিয়ে ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর আবারো এনবিআর থেকে স্পষ্টীকরণ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামিট করপোরেশন লিমিটেড নিবন্ধিত করদাতা। এই কোম্পানির ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ সালের নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী যাচাই ও বিশ্লেষণ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এতে দেখা গেছে, সামিট করপোরেশন ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট লভ্যাংশ ঘোষণা বা প্রদান করেছে দুই হাজার ৯১৭ কোটি ৭১ লাখ ৩২ হাজার ৩৭৪ টাকা। যার উপর প্রযোজ্য উৎসে কর ৪৩৭ কোটি ৬৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এক টাকাও উৎসে কর কর্তন করেনি। সুদসহ এই উৎস কর দাঁড়িয়েছে ৬৪৭ কোটি ৭৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৭ টাকা। অর্থাৎ সামিট পাওয়ার সামিট করপোরেশন ও সামিট করপোরেশন সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে মোট এক হাজার ১১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার উৎসে কর কর্তন না করে ফাঁকি দিয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামিট করপোরেশনের মোট শেয়ারের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (সিঙ্গাপুরভিত্তিক অনিবাসী কোম্পানি)। বাকি শূন্য দশমিক শূন্য এক শতাংশ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ধারা ১৮(৩) ও আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২৭(ঘ) অনুযায়ী, বাংলাদেশে কোন কোম্পানি কর্তৃক বাংলাদেশের বাইরে পরিশোধিত কোন লভ্যাংশ বাংলাদেশ উদ্ভুত হয়েছে বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, লভ্যাংশের উপর ১৫ শতাংশ হারে কর কর্তনের বিধান থাকা সত্ত্বেও এনবিআরের স্পষ্টীকরণের কারণে সামিট করপোরেশন কর্তৃক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া লভ্যাংশের ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন করা হয়নি।

অপরদিকে, সিআইসির তদন্তে এই অসঙ্গতি ধরা পড়ায় আয়কর নীতি উইং সম্প্রতি আগের স্পষ্টীকরণ দুটি বাতিল করেছে। একইসঙ্গে নতুন একটি স্পষ্টীকরণ জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে সামিট পাওয়ার লিমিটেডকে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে। একইসঙ্গে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির আওতায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক অনিবাসী (বিদেশি) কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে সামিট করপোরেশনকে ১৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করতে হবে।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে সামিট পাওয়ার লিমিটেডের কোম্পানি সচিব স্বপন কুমার পাল এর ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াইটঅ্যাপ নাম্বারে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে দেওয়া হলেও কোন জবাব দেননি।

এই বিষয়ে এনবিআরের <strong>আয়কর বিভাগের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সামিট পাওয়ার লিমিটেড অত্যন্ত সুকৌশলে সামিট করপোরেশন লিমিটেডকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন করেনি। এনবিআর থেকে বিষয়টি স্পষ্টীকরণ করা হলেও তারা আমলে নেয়নি। অর্থাৎ করফাঁকি দেওয়ার জন্য সামিট পাওয়ার এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। একইসঙ্গে সামিট করপোরেশন লিমিটেড সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের ব্যতয় ঘটিয়ে এক টাকাও উৎসে কর কর্তন করেনি। ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে, এখন সংশ্লিষ্ট কর অফিস ব্যবস্থা নেবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!