সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকাল সাড়ে আটটার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. নাসিরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, খায়রুল হককে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জে মোট তিনটি মামলা রয়েছে। এর যেকোনো একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত মামলার রায় প্রদানকারী হিসেবে রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। তাঁর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় জালিয়াতির মাধ্যমে রায় দেওয়া ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট এই মামলা দায়ের করেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী ভূঁইয়া। এছাড়াও রাজধানী ঢাকায় তাঁর বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা রয়েছে।
দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান, যা কার্যকর হয় ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে। তিনি ২০১১ সালের ১৭ মে অবসর গ্রহণ করেন। পরে, ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তাঁকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও কয়েক দফা তাঁকে ওই পদে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়। সর্বশেষ, ২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
আপিল বিভাগে থাকাকালে খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দেন। হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত থাকাকালে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত মামলার রায় প্রদান করেন। এছাড়াও ঢাকার চার নদী রক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তাঁর রায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় খায়রুল হক ছিলেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলে ১৩ আগস্ট তিনি আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
বিচারাঙ্গনে তুমুলভাবে আলোচিত-সমালোচিত এই বিচারপতির কয়েকটি রায় চরম বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। তিনি নিজে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙিয়ে। প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ত্রাণ তহবিলের টাকা গ্রহণ করে নিজের চিকিৎসা করে সমালোচিত হয়েছিলেন। অবসর গ্রহণ করার কয়েকদিন আগে তিনি ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। এতে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতের পথ উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি শেখ হাসিনার ভোট ডাকাতির চূড়ান্ত সুযোগ তৈরি হয়। রাজনৈতিক একটি বিষয়কে আদালতের আওতাধীন করে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি।
এছাড়া বিতর্কিত একাধিক বিচারপতিকে শপথ পড়ানো, আগাম জামিনের এখতিয়ার কেড়ে নেয়া, খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই কয়েকটি মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১৮ আগস্ট ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন এবং জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়। ২৮ আগস্ট দুর্নীতি ও রায় জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আরেক আইনজীবী। এর আগে ২৫ আগস্ট খায়রুল হকের বিরুদ্ধে একই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় আরেকটি মামলা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলেও এ বি এম খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা-এই তিনজনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এমনকি আপিল বিভাগে সাত বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রকাশ্যে দেয়া রায়ের মূল অংশ ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। ওই অংশকে চূড়ান্ত রায়ে গায়েব করে দেন খায়রুল হক। তার সঙ্গে একমত হন মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার:
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। আইন কমিশনে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করতেন এসএম সামসুল আলম। ২০১৩ সালে ক্ষমতার ব্যবহার করে সামসুল আলমকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান এ বি এম খায়রুল হক। সামসুল আলম চাকরি হারিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি তিনি চাকরি ফেরত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর আবেদন করেছেন।