সাদাপাথর লুট: স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও জড়িত

দুদকের প্রতিবেদন

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পর্যটন এলাকা থেকে সাদাপাথর চুরির ঘটনায় সরকারের ছয়টি প্রশাসনিক সংস্থা ও বিভাগ জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সাদাপাথর সংরক্ষণের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থাকলেও তারা তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দুদকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের গোয়েন্দা শাখার অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় ৪২ জন রাজনৈতিক ব্যক্তি, পাথর ব্যবসায়ী ও অন্যান্যরা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যোগসাজশে কয়েকশ কোটি টাকার সাদাপাথর চুরি করেছেন। এ ঘটনায় কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে দুদকের হাতে প্রমাণ রয়েছে, তারা হলেন—বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার অফিসার ইনচার্জ, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর কর্মকর্তা এবং বিজিবি সদস্যরা।

দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, কমিশনের এনফোর্সমেন্ট টিম ভোলাগঞ্জে অভিযান চালিয়ে অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিনি বলেন, শিগগিরই অভিযোগটির প্রকাশ্য অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়া হবে। এরপর অনুসন্ধান শেষে দাখিল করা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সময় পাথর চুরিতে জড়িত চিহ্নিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সরকারি সংস্থা ও প্রশাসনের চোখের সামনে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি হতে পারে না। তারা এই দায় এড়াতে পারবেন না। ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

সিলেট বিভাগীয় কমিশনারকে নিয়ে বক্তব্য

সিলেটে ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ রয়েছে। সিলেট বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী গত ৮ জুলাই তাঁর কার্যালয়ে পাথর ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, ‘সারাদেশে পাথর উত্তোলন করা হয়, সিলেটে কেন যাবে না? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত।’ তাঁর এ বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং সাদাপাথর লুটপাটে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে। সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর চুরিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফলে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের বদলে তিনি পাথর-সংক্রান্ত ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা নিয়েছেন।

খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোকে ঘিরে যা বলা করা হয়েছে

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদাপাথর চুরি প্রতিরোধে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। প্রকাশ্য অনুসন্ধানে তাদের কর্তব্যে অবহেলার দায় নির্ণয় করা হবে। দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, সাদাপাথর মূলত একটি খনিজ সম্পদ। খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন-১৯৯২ এবং এই আইনের ভিত্তিতে প্রণীত খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা-২০১২ অনুযায়ী, বিএমডি সারাদেশে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের (তেল ও গ্যাস ব্যতীত) সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে। এই সংস্থা খনি ও কোয়ারি ইজারা এবং অনুসন্ধান লাইসেন্স প্রদান করে। বিধিমালা-২০১২-এর বিধি ৯১ ও ৯৩ অনুযায়ী, খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকা থেকে অবৈধভাবে সম্পদ উত্তোলন বা বেহাত হলে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় তা উদ্ধার করতে হবে। এ সংক্রান্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও বিএমডির।

জেলা প্রশাসককে নিয়ে বক্তব্য

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি বিধি অনুযায়ী পর্যটন স্পটগুলোর নান্দনিক সৌন্দর্য বজায় রাখাসহ পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব। পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এবং সংশ্লিষ্ট জেলার আওতাধীন রাষ্ট্রীয় সম্পদ (ভূমি ও ভূমি সংশ্লিষ্ট) রক্ষার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের হলেও পাথর লুটপাট ঠেকাতে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার তথ্যপ্রমাণ মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানকালে। তাঁর অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সাদাপাথর পর্যটন স্পট রক্ষায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এই স্পটের বর্তমান অবস্থা এক দিনে হয়নি। পাথর উত্তোলন সাত-আট মাস ধরে চললেও জেলা প্রশাসক ও তাঁর অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

পুলিশ সুপারকে নিয়ে বক্তব্য

চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধের জন্য পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করলেও সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সাদাপাথর লুটপাটের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। পুলিশ সুপারের নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশের কারণে সাদাপাথর লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে।

কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রসঙ্গে বক্তব্য

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে কোম্পানীগঞ্জে বিশেষ করে সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় দিনে-দুপুরে উপজেলা প্রশাসনের চোখে চোখ রেখে পাথর লুটপাট হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, উর্মি রায় ও আবিদা সুলতানা নামমাত্র ব্যবস্থা ছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথরের বাণিজ্য থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে ট্রাক প্রতি পাঁচ টাকা ও নৌকা প্রতি একই হারে কমিশন প্রদান করা হতো। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা না করা বা উত্তোলনে বাধা না দিলে এই অর্থ ঘুষ হিসেবে তোলা হতো। ভূমি অফিস ও উপজেলা প্রশাসনের নির্দিষ্ট কর্মচারীর মাধ্যমে এই টাকা সংগ্রহ করা হতো।

বিজিবিকে নিয়ে বক্তব্য

কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর এলাকায় ৩টি বিজিবি ক্যাম্প ও পোস্টের অবস্থান ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ মিটার থেকেও কম। এত ঘনিষ্ঠ অবস্থান থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কমান্ডারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ইকবাল হোসেনসহ বিজিবি সদস্যরা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ এবং নিষ্ক্রিয়তার কারণে পাথর উত্তোলনকারীরা সহজেই লুটপাট করতে পেরেছে। অভিযানে জানা গেছে, বিজিবি সদস্যরা নৌকা প্রতি ৫০০ টাকা নিলে নৌকাগুলো প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন এবং পাথর উত্তোলনের সময় কোনো বাধা দেননি।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসিকে নিয়ে বক্তব্য

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সরকারি সম্পদ রক্ষা ও অবৈধ দখল রোধের দায়িত্ব থানা পুলিশ ও ওসির ওপর থাকে। সেই সময় কোম্পানীগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে সাদাপাথর লুটপাটে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন, দুদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫শ ঘনফুট পাথর লোড করা হয়। পরিবহন ভাড়া ছাড়াও প্রতিটি ট্রাকের পাথরের দাম ধরা হয় ৯১ হাজার টাকা, যার মধ্যে ১০ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হয়। পুলিশের (ওসি, সার্কেল এএসপি, এসপি ও অন্যান্য) জন্য পাঁচ হাজার এবং প্রশাসনের (তহশিলদার, এসিল্যান্ড, ইউএনও, জেলা প্রশাসক ও অন্যান্য) জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হয়। এছাড়া প্রতিটি বারকি নৌকা থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়, যার মধ্যে পুলিশ ও প্রশাসন প্রতি পাশে ৫শ টাকা করে পায়। এসব অবৈধ অর্থ পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে সংগ্রহ করে।

** সাদাপাথর লুট, বিএনপি নেতার পদ স্থগিত

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!