‘সাজিনাজ এক্সিম’: মোড়ক-লেভেল বিক্রিতে দেয় রাজস্ব ফাঁকি

## ইউনিলিভার, ম্যারিকো, প্রাণ, স্কয়ার, বনফুল, পারটেক্স, এসিআইসহ বড় কোম্পানির ব্র্যান্ডেড পণ্যের প্যাকেট (মোড়ক) তৈরি ও সরবরাহ করেহ এই প্রতিষ্ঠান
## এক অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধ করেনি ৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা

রাসেল মো. শাহেদ: তৈরি করেন পণ্যের মোড়ক ও লেভেল। দেশের বনেদি কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানিতে এসব মোড়ক ও লেভেল সরবরাহ বা বিক্রয় করে। কিন্তু এই মোড়ক ও লেভেল বিক্রিতে পরিশোধ করেন না সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট। যাতে এক অর্থবছরে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। সাজিনাজ এক্সিম প্যাক লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের বিসিক শিল্প এলাকার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির তথ্য পেয়েছে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর। রাজস্ব ক্ষতি করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআরকে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বনেদি কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানিতে মোড়ক ও লেভেল সরবরাহ বা বিক্রিতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফাঁকি দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে।

Shajiinaz 1

এনবিআর সূত্রমতে, বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এনবিআরের নিয়ন্ত্রণাধীন ভ্যাট কমিশনারেটের সার্কেলসমূহের ২০২০-২১ অর্থবছরের (২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) কার্যক্রম এবং অনিয়ম সংক্রান্ত অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট (এআইআর) সম্পন্ন করেছে। নিরীক্ষায় সাজিনাজ এক্সিম প্যাক লিমিটেডের রাজস্ব (সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট) অনিয়ম উঠে এসেছে। পরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পৃথক দুইটি প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে।

সম্পূরক শুল্ক অনিয়ম সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাজিনাজ এক্সিম প্যাক ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩০ টাকা রাজস্ব ক্ষতি বা ফাঁকি দিয়েছে। ফ্লেক্সিবল প্রিন্টেড বা লেমিনেটেড ফিল্ম পণ্যের বিক্রয়ের উপর ৫ শতাংশ হারে এই সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রয় করেছে ১০ কোটি ৮৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭১ টাকা, যাতে ৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। অক্টোবরে বিক্রয় করেছে ৯ কোটি ২ লাখ ৯৪ হাজার ৮৩৯ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। নভেম্বর বিক্রয় ৮ কোটি ৬০ লাখ ৮৯ হাজার ৩২৯ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৪৩ লাখ টাকা। ডিসেম্বরে বিক্রয় ৯ কোটি ৪৭ লাখ ৫৩ হাজার ৯৯১ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৪৭ লাখ টাকা। জানুয়ারি মাসে বিক্রয় ১১ কোটি ৫২ লাখ ৫৯ হাজার ৯০৯ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় সাড়ে ৫৭ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে বিক্রয় ১১ কোটি ১৮ লাখ ৬ হাজার ৯৫ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। মার্চ মাসে বিক্রয় ১২ কোটি ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬৮৩ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এপ্রিলে বিক্রয় ১২ কোটি ৯১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫২ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক সাড়ে ৬৪ লাখ টাকা। মে মাসে বিক্রয় ১১ কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৬ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় সাড়ে ৫৮ লাখ টাকা। জুন মাসে বিক্রয় ১৪ কোটি ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৯৩১ টাকা, যাতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক প্রায় ৭০ লাখ টাকা।

নিরীক্ষাকালে প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে তৈরি পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের সময় এই সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করেনি। এনবিআরের ২০১৮ সালের এক আদেশে বলা হয়েছে, পলিইথিলিনের তৈরি সকল ধরনের পলিথিন ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর উপর ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা-৫৫ ও দ্বিতীয় তফসিলে (টেবিল-২, হেডিং-৩৯.২৩ অন্তর্ভূক্ত) অন্তর্ভূক্ত পণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপিত আছে। তবে পলিইথিলিনের তৈরি পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়ক সামগ্রীর উপর উৎপাদন পর্যায়ে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক নিয়ে মাঠ পর্যায়ে জটিলতা তৈরি হয়। এই নিয়ে এনবিআর ২০১৯ সালে একটি আদেশ জারি করে। যাতে উৎপাদন পর্যায়ে এই ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়। এই সম্পূরক শুল্ক আদায় করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সার্কেল থেকে স্বীকার করা হয়েছে।

Shajiinaz

ভ্যাট সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য বিক্রিতে ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এসব পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বিক্রয় করেছে (মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয়মূল্য) প্রায় ১০৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যাতে প্রযোজ্য ভ্যাট ৮৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৪ টাকা, প্রতিষ্ঠানটি পরিহার বা ফাঁকি দিয়েছে। দুইটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

এই বিষয়ে সাজিনাজ এক্সিম প্যাক লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ মমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা এই সম্পূরক শুল্ক এই বাজেটে আমরা মাফ পেয়ে গেছি। চলতি বাজেটে এই সম্পূরক তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে তো তুলে দেয়া হয়নি-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না না, আমরা ২০১৯ সাল থেকে মাফ পাবো।’ রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর থেকে সম্প্রতি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রতিবেদন দিতেই পারে।’ আপনারা জেনে শুনে এই সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়েছেন কিনা-এমন প্রশ্নে মুহাম্মদ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো পাটি থেকে এই টাকা নিতে পারি না। কিভাবে দেবো?’ তবে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি ষ্পষ্ট করার আগেই ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।

###

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!