বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে তার জায়গায় আসছে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’। দীর্ঘ আলোচনা ও পর্যালোচনার পর এই অধ্যাদেশের খসড়াটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। নতুন খসড়ায় আগের আইনের ৯টি বিতর্কিত ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে।
মতপ্রকাশসংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু দুটি বিষয়কে অপরাধ হিসেবে রাখা হয়েছে—একটি নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনমূলক কনটেন্ট প্রকাশ বা হুমকি, অন্যটি ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য বা কনটেন্টের মাধ্যমে সহিংসতা সৃষ্টি।
খসড়ায় প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকারকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অনলাইন জুয়াকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৬ মে) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বৈঠক হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ সময় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করতে বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ করা হয়েছে। খসড়াটি পরিবর্তন করা হয়েছে ২৫ বার। সবশেষে বড় সমালোচক সুশীল সমাজের সঙ্গে তিন ঘণ্টা বসে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ওঠে। এখন আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি যাচাইয়ের (ভেটিং) পর অধ্যাদেশ জারি হবে। আশা করা হচ্ছে, এ সপ্তাহের মধ্যে এটি কার্যকর হবে।প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এই ধারাগুলো ছিল ‘কুখ্যাত’। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৯৫ শতাংশ মামলাই এসব ধারায় হয়েছিল। এই মামলাগুলো এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এ ছাড়া ইতঃপূর্বে বিভিন্ন ধারায় যেসব মামলা করা হয়েছিল, সেগুলোও বাতিল হয়ে যাবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ড-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদি সংক্রান্ত ধারা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। এই ধারায় অনেক সাংবাদিকও ভুক্তভোগী হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন আসিফ নজরুল। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন, তথ্য-উপাত্ত পাঠানো, প্রকাশ ইত্যাদি ধারাও বিলুপ্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আইনের কিছু ধারা সংশোধন করা হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, প্রস্তাবিত ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে’ মতপ্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধ বা ‘স্পিচ অফেন্স’-এর মধ্যে কেবল দুটি বিষয়কে অপরাধ হিসেবে রাখা হয়েছে। একটি হলো—নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনমূলক কনটেন্ট প্রকাশ বা হুমকি প্রদান, অন্যটি ধর্মীয় ঘৃণা ছড়িয়ে সহিংসতা উস্কে দেওয়া। তিনি জানান, ধর্মীয় ঘৃণার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যাতে আইনের অপব্যবহার বা অহেতুক হয়রানির সুযোগ না থাকে। ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য বা সহিংসতা উস্কে দিতে পারে—এমন কনটেন্টকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আসিফ নজরুল আরও জানান, এই দুটি ধারায় রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এমন মামলাগুলো সরাসরি আমলি আদালতে যাবে এবং আদালত চাইলে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) না আসার আগেই, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, মামলা বাতিল করতে পারবেন যদি সেটি ভিত্তিহীন মনে হয়। এছাড়া এই অপরাধগুলো কিছু ক্ষেত্রে আপসযোগ্য রাখা হয়েছে এবং মতপ্রকাশ-সম্পর্কিত বিষয়গুলো জামিনযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে যদি সাইবার অপরাধ করা হয়, তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য করা হয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি রাখার বিধান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কনটেন্ট অপসারণের পর আদালতের অনুমতি নিতে হবে। আদালত যদি বলেন এই কনটেন্ট অপসারণ করা যাবে না, তাহলে তা পুনর্বহাল করতে হবে। যে কনটেন্ট অপসারণ করা হবে, সেটি সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে।