চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) দেড় দশকের বেশি সময় ধরে পরিচালনা করেছে সাইফ পাওয়ারটেক। এ দুই টার্মিনাল ঘিরেই গড়ে উঠেছিল কোম্পানির মূল ব্যবসা, যার পেছনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ এবং বিনিয়োগকারীদের আরও ৫০০ কোটির বেশি অর্থ জড়িত। কিন্তু হঠাৎ এনসিটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর এবার সিসিটি নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ রয়েছে, তবে বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা—চুক্তি নবায়ন আর হবে না। এ পরিস্থিতিতে সাইফ পাওয়ারটেকের শেয়ারদর মারাত্মকভাবে পতিত হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা অর্থ এখন চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
বিভিন্ন খাতে ব্যবসা থাকলেও সাইফ পাওয়ারটেকের মূল ভরসা ছিল বন্দরকেন্দ্রিক কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত দুটি টার্মিনাল মিলেই চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৬৫ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হতো, যার মধ্যে একা এনসিটিতেই সম্পন্ন হতো ৪৫ শতাংশ কাজ। বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার এনসিটিতে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় সাইফ পাওয়ারটেকের কাছ থেকে এনসিটির নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যেই বুঝে নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০৬ সালে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে সাইফ পাওয়ারটেক প্রথম বন্দর কার্যক্রমে যুক্ত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে, অনেকেই একসময় সাইফ পাওয়ারটেককেই বন্দরের মতো দেখত। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালে মোট ১২টি জেটির মাধ্যমে কনটেইনার ওঠানামার কাজ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক যন্ত্রপাতিসম্পন্ন টার্মিনাল এনসিটির চারটি জেটি ও সিসিটির দুটি জেটি পরিচালনা করত সাইফ পাওয়ারটেক।
দেশের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণকে ভিত্তি করে সাইফ পাওয়ারটেক শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়। ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা পরিচালনার জন্য ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউসিবিএল, হজ ফাইন্যান্স এবং প্রিমিয়ার লিজিংয়ের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে। পাশাপাশি, রয়েছে আরও ৪০০ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ। তবে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব হারানোর পর এসব ঋণ আদায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে গভীর দুশ্চিন্তায়। এর মধ্যে এককভাবে সর্বোচ্চ—প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার—ঋণ রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঝুঁকিতে।
সরকার পতনের পর থেকেই সাইফ পাওয়ারটেক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর, যখন সম্ভাব্য বিপদের আভাস পেয়ে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘোষিত ১ শতাংশ লভ্যাংশ নির্ধারিত সময়মতো দিতে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। ওই অর্থবছরে সাইফ পাওয়ারটেকের সমন্বিত শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৭০ পয়সা, আর শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ ছিল এক টাকা ৮৮ পয়সা। ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ১৭ টাকা এক পয়সা। যদিও গত ৩০ ডিসেম্বর বার্ষিক সাধারণ সভায় লভ্যাংশ অনুমোদন নেওয়া হয়, কিন্তু ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বিনিয়োগকারীরা মাত্র ১০ পয়সা পরিমাণ লভ্যাংশও হাতে পাননি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি সাইফ পাওয়ারটেক। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের (জুলাই-জুন) জন্য কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ হিসাবে, প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে একজন বিনিয়োগকারী পান ১০ পয়সা করে, যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় তিন কোটি ৭৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। তবে ঘোষণার ছয় মাস পার হলেও এখনো ওই লভ্যাংশ পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। অথচ কোম্পানির রিজার্ভে রয়েছে ১৬৮ কোটি টাকা। এ অবস্থায় লভ্যাংশ না পাওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়ছে।
সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, সরকার যখন এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন থেকে আমাদের কোম্পানির ওপর চাপ বেশি বাড়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, তা আমাদের চাপে অনেক বেশি। আমরা অন্যদের মতো পালিয়ে যাইনি, বরং পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছি। যদিও গত বছরের লভ্যাংশ পুরোপুরি দিতে পারিনি, তবে আংশিকভাবে তা পরিশোধ শুরু করেছি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, খুব শিগগির সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অপরদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মুখপাত্র আবুল কালামের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
**এনসিটি ছাড়ছে সাইফ পাওয়ারটেক
**সাইফ পাওয়ারটেকের সম্পত্তি নিলামে
**রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বন্দরে গাড়ি চালায় সাইফ পাওয়ারটেক
**বন্দরে সাইফ পাওয়ারটেকের সব ‘অনিয়ম-ই-নিয়ম’
**বন্দরের ‘ক্ষমতাধর’ সাইফ পাওয়ারটেক
**সাইফ পাওয়ারটেকের অভিযোগ তদন্ত করবে দুদক
**জাল কাগজ তৈরিতে সাইফ পাওয়ারের কর্মচারী
**সাইফ পাওয়ারকে বিদায়ে লাগলো ১৭ বছর
**ম্যানেজ করেই বন্দরে কাজ পান ‘সাইফ পাওয়ার’