চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে সরকারের দেশি ও বিদেশি ঋণের মোট পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরের শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি নতুন সরকার গঠিত হয়, তবে শুরুতেই তাদের মোকাবিলা করতে হবে বিপুল ঋণের চাপ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, এই ঋণের মধ্যে দেশি ঋণের পরিমাণ হবে ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ দাঁড়াবে ১০ লাখ ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘিরে অর্থ বিভাগ যে তিন বছর মেয়াদি মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তার পর্যালোচনায় উঠে এসেছে সরকারের ঋণ পরিস্থিতির পূর্বাভাস। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২৬ লাখ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর তার পরের বছর অর্থাৎ ২০২৭-২৮ অর্থবছর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
অর্থ বিভাগের নীতি-বিবৃতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে প্রাক্কলিত ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। তবে পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার তা সংশোধন করে ২১ লাখ ১১ হাজার ৯০০ কোটিতে নামিয়ে আনে।
নীতি-বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনো সহনীয় মাত্রায় রয়েছে, তবে তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন পর্যন্ত বৈদেশিক ও সামগ্রিক ঋণকে ‘নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে একইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় যে চাপ তৈরি হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে দেশের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
সদ্য প্রকাশিত সরকারের মধ্যমেয়াদি (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৬-২৭) ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন নিম্ন ঝুঁকি থেকে প্রায় উচ্চ ঝুঁকির অবস্থানে পৌঁছে গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্থ বিভাগ সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানির অনুপাতে। বিভাগটির তথ্য অনুযায়ী, এ অনুপাত বর্তমানে ১৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। এ অবস্থার উন্নয়ন না হলে মধ্য মেয়াদে ঋণ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
গত অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৫৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা করেছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। পরবর্তী অর্থবছরের মূল বাজেটে এ অনুপাত বেড়ে ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও, অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৪১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
নীতি-বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ২০২ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছর শেষে এ ব্যয় বেড়ে ২৬১ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা ২৯০ কোটি, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩১২ কোটি এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৩৩৪ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। সুদসহ পরিশোধের মোট পরিমাণ হলে এ অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণ-জিডিপির অনুপাত যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় পরিমাণ বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ করতে হবে। এখন সময় এসেছে ঋণ নেওয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি করার। পাশাপাশি কর-জিডিপির অনুপাতের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়াও জরুরি। তিনি আরও জানান, আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ঋণ-জিডিপির অনুপাত নিয়ন্ত্রণে থাকায় আগের সরকার নির্বিচারে ঋণ গ্রহণ করেছে, যা ছিল নিজেদের দুর্বলতাকে আড়াল করার মতো পরিস্থিতি। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ভবিষ্যতে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।