সরকারি প্রকল্পে গুটিকয়েক ঠিকাদারের দখল

আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি কেনাকাটার বাজার কার্যত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যা এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের মাত্র ৫ শতাংশ ঠিকাদারই মোট চুক্তিমূল্যের ৬১ শতাংশ কাজ পেয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে সরকারি কেনাকাটায় একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য: একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি আজ মঙ্গলবার টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়। গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা সুমাইয়া খায়ের, সহকারী কো-অর্ডিনেটর রিফাত রহমান ও কে এম রফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

টিআইবির গবেষণায় ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হওয়া ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪৭৪টি কেনাকাটার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সময়ে ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মোট ব্যয় হয়েছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। গবেষণায় দেখা গেছে, শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদারই মোট চুক্তিমূল্যের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ কাজ পেয়েছে। বিপরীতে, সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারের অংশীদারত্ব সব মন্ত্রণালয় মিলিয়ে ১ শতাংশেরও কম।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র অনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সুস্থ প্রতিযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ৫ শতাংশ ঠিকাদার গত এক দশকে তাঁদের বাজার অংশীদারত্ব আরও বাড়িয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মাত্র ৩৫ জন ঠিকাদার প্রায় ৭৩ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৩৮ জন ঠিকাদারের দখলে রয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৮১ জন ঠিকাদার নিয়ন্ত্রণ করছে ৩২ শতাংশ, আর স্থানীয় সরকার বিভাগে ২৯৪ জন ঠিকাদার প্রায় ২৮ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে।

টিআইবি বলেছে, বাজার দখলের পেছনের কারণ হলো, শীর্ষ ঠিকাদাররা যৌথ উদ্যোগ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার গঠন করে বড় প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগে ৯টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। একইভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১২টি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১১টি ঠিকাদারি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি কেনাকাটা খাত সারা বিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ। তবে বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারত্বের হাতে জিম্মিদশায় নিমজ্জিত হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায়নি; বরং ইলেকট্রনিক উপায়ে কেনাকাটাব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে বাজার দখল আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।তিনি বলেন, কর্তৃত্ববাদ–পরবর্তী রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পরিপ্রেক্ষিতে একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে কি না, এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং ই-জিপি প্রক্রিয়ার যুগোপযোগী সংস্কারের ওপর নির্ভর করবে।

সরকারি কেনাকাটায় সুশাসন নিশ্চিত করতে টিআইবি ছয় দফা সুপারিশ করেছে। সংস্থাটির প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে—বাজার দখল রোধে জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিবিড় নজরদারি; সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রতিযোগিতামূলক আইন প্রণয়ন ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের কার্যক্রম সীমিতকরণ; একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা; এবং ই-প্রকিউরমেন্টের বাইরে থাকা চুক্তিগুলো দ্রুত ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার আওতায় আনা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!