সরকারি পর্যবেক্ষণের অভাবে বাড়ছে তামাক চাষ

সরকারি পর্যবেক্ষণের অভাবে কুষ্টিয়ায় লাগামহীনভাবে বাড়ছে তামাক চাষ। তামাক কোম্পানিগুলো বীজ, সার, কীটনাশক ও আর্থিক সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। ফলে ধান, গম ও ভুট্টার জায়গা দখল করছে ক্ষতিকর এই ফসল। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও বেশি মুনাফার আশায় নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরাও তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে জড়িত হয়ে পড়ছেন।

তবে কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।দেশের যেসব জেলায় তামাক চাষ বেশি হয় তার মধ্যে কুষ্টিয়া অন্যতম। এ জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার কৃষকরা তামাক চাষের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকেছেন। বিভিন্ন এলাকায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাকের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন শিশু বৃদ্ধসহ তামাক চাষির পরিবারের সবাই।

বছরের পর বছর ধরে তামাক চাষে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। অনেকে অনেক ধরনের রোগে আক্রান্ত হন। অন্যদিকে জমির উর্বরতা ও ফসল উৎপাদন কমছে। চলতি মৌসুমে এ জেলায় প্রায় ১১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এসব তামাক পোড়ানোর জন্য হাজারো ঘর বানানো হয়েছে। আর এসব ঘরের চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে হাজার হাজার টন জ্বালানি কাঠ। তামাক পোড়ানোর ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি, ঢাকা ট্যোবাকো, জাপান ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ট্যোবাকো, নাসির ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকোসহ বেশ কয়েকটি তামাক কোম্পানি বীজ, সার, কীটনাশক ও অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধাসহ বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে তামাক চাষ করতে চাষিদের আগ্রহী করে তুলেছে। এ কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতা, বিনামূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নগদ অর্থসহ তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তার কারণে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাক চাষ বন্ধ করে বিকল্প ফসলের আবাদ করার ও তামাক চাষের ক্ষতি তুলে ধরে সরকারিভাবে প্রশাসন ও কৃষি বিভাগকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহলের মানুষ।কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও তামাক কোম্পানির লোভনীয় আশ্বাসের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। কৃষকদের তামাক চাষের কুফলগুলো বোঝাচ্ছেন এবং তামাকের বদলে অন্যান্য ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, কুষ্টিয়ার ছয় উপজেলায় চলতি মৌসুমে প্রায় ১১ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। গত বছরে ১০ হাজার ৯৩১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছিল। প্রতিবারই দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ করা হয়। ২০১৯-২০ সালে দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলায় তামাক চাষ হয়েছিল ১০ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে। এবার চাষ হয়েছে ১১ হাজার ৩৬৬ হেক্টর জমিতে।

তারমধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৬৮৫ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৮৩০ হেক্টর এবং মিরপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৮৫১ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে। যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। মিরপুর উপজেলায় কৃষি জমি ২৩ হাজার ১১১ হেক্টর, ভেড়ামারায় ১০ হাজার ৮৯১ হেক্টর এবং দৌলতপুর উপজেলায় কৃষি জমি রয়েছে ৩২ হাজার ৪৪৮ হেক্টর।

জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে তামাক খেত। তামাকের খেতে কেউ পরিচর্যা করছেন, কেউ নষ্ট পাতা কাটছেন, তামাক পাতা তুলছেন। আবার কেউ তামাকের পাতা মাঠ থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ তামাক শক্ত লাঠির সঙ্গে বাঁধছেন। তামাক পোড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতের কাজ করছেন নারী, বৃদ্ধা ও শিশুরা।

Untitled design 93

এদিকে প্রান্তিক কৃষকরা জমিতে তামাক পাতা তোলা ও পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বসত বাড়ির আশপাশ ও রাস্তার দুই পাশে তামাক পোড়ানোর ঘর তৈরি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে এলাকার বৃদ্ধ, শিশু-কিশোররা। বীজ, সার ও অগ্রিম ঋণসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় ইরি-বোরো ও রবিশস্যের পরিবর্তে তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। সরকারি নজরদারির অভাব ও তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে পড়ে ক্ষতিকর বিষবৃক্ষ তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। বেড়েই চলেছে চামাক চাষ।

তামাক চাষিরা বলেন, বহু বছর ধরে কুষ্টিয়ায় তামাক চাষ হয়। তবে জেলার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ হয়। তামাক কোম্পানি গুলো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে সার, কীটনাশক, বীজ ও অর্থ দেন। এজন্য অন্যান্য ফসলের আবাদ ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকেছে। প্রতি বছর চার মাস তামাক চাষে ব্যস্ত থাকে কৃষকরা।

তারা আরও বলেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি পরিমাণ পরিশ্রম হয়। স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়, অনেকে ফুসফুস ও চর্ম রোগে আক্রান্ত হন। স্বাস্থ্যের ক্ষতি জেনেও রাত-দিন পুরুষ-নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা কাজ করে। তামাকের সময় বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তামাক চাষে ক্ষতি ও পরিশ্রম কষ্ট বেশি হলেও লাভ বেশি। প্রতি বিঘায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার তামাক বিক্রি হয়। খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা যথেষ্ট আন্তরিক ও তৎপর রয়েছেন। তামাক চাষ বন্ধ করে ধান, ভুট্টা, গম, আলুসহ ফল চাষ করার জন্য নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তামাক চাষে মাটির উর্বরতা কমে যায়। কৃষকদের সচেতন হতে হবে এবং তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে।

**ভর্তুকির সার যাচ্ছে তামাক চাষে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!