‘অনানুগত্য’ শব্দটি তুলে দিয়ে ‘সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। নতুন এই অধ্যাদেশে সরকারের বৈধ আদেশ অমান্য করাকে ‘সরকারি কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অসদাচরণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে জারি করা এ অধ্যাদেশটি অবিলম্বে কার্যকর হয়েছে।
দ্বিতীয় সংশোধিত অধ্যাদেশে পরিমার্জন করে শৃঙ্খলা ভঙ্গের তিন ধরনের অপরাধের উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন অধ্যাদেশের ৩৭ (ক) ধারায় ‘সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও দণ্ড সংক্রান্ত বিশেষ বিধান’-এ বলা হয়েছে, আইনের অধীন প্রণীত বিধিমালায় যা-ই থাকুক না কেন, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী—
ক. ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য করেন, আইনসংগত কারণ ছাড়া সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র বা নির্দেশ পালন না করেন, বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেন অথবা অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে এ কাজে প্ররোচিত করেন;
খ. ছুটি বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে সমবেতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা কাজে বিরত থাকেন;
গ. অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে বা কর্মস্থলে উপস্থিত হতে বাধা দেন
এসব কর্মকাণ্ডকে ‘সরকারি কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অসদাচরণ’ হিসেবে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে দণ্ডমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আগের অধ্যাদেশে থাকা ‘সরকারি কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, যার ফলে অন্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি হয়, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় বা কর্তব্য পালনে বাধা সৃষ্টি হয়’—এই ধারা নতুন অধ্যাদেশ থেকে বাতিল করা হয়েছে। পরিবর্তে, সংশোধিত অধ্যাদেশে এমন অপরাধের জন্য তিন ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে—নিম্ন পদ বা বেতন গ্রেডে অবনমন, বাধ্যতামূলক অবসর এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত।
আগের অধ্যাদেশে দোষী কর্মচারীর জন্য নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমন, চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা বরখাস্ত করার বিধান ছিল। সংশোধিত অধ্যাদেশে শাস্তি নির্ধারণে এক সদস্যের পরিবর্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের নিয়ম করা হয়েছে, যেখানে একজন নারী সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক। এছাড়া কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে আগের অধ্যাদেশে রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের যে সুযোগ ছিল, নতুন অধ্যাদেশে তা রাখা হয়নি।
গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদ সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে তা অধ্যাদেশ আকারে জারির প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ মে থেকে সচিবালয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই ২৫ মে রাতে সরকার সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি করে। নতুন অধ্যাদেশে পুরোনো আইনের সঙ্গে ‘৩৭ক’ নামক একটি ধারা যুক্ত করা হয়। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী দায়ী হলে, তাঁকে সাত দিনের নোটিশ দেওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
নতুন বিধানে বলা হয়েছে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, যা অনানুগত্যের শামিল এবং অন্য কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে কিংবা কর্তব্য পালনে বাধা সৃষ্টি করে—তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া, যদি কেউ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে ছুটি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, কাউকে কর্মবিরতিতে উসকানিও দেন বা বাধ্য করেন, কিংবা অন্য কোনো কর্মচারীকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন—তবে সেটিও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
অধ্যাদেশটিকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে এর বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই পরিস্থিতিতে, গত ৪ জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আন্দোলনরত কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে অধ্যাদেশটি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে, ৩ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদ সংশোধিত সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ অনুমোদন করে, যা এখন অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে।