সয়াবিন তেলের সিন্ডিকেট ফের সক্রিয়, লিটারে আরও ১৫ টাকা বৃদ্ধির অপেক্ষায়। রোজার আগে সরকারিভাবে এক দফা দাম বাড়ানো হলেও বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। এবার ঈদের আগে আরেক দফা বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নিতে চক্রটি নতুন ফাঁদ পেতেছে। আমদানি করা ভোজ্যতেল বন্দরে খালাস না করে ‘মাদার ভেসেল’ থেকে ‘লাইটার জাহাজে’ আনলোড করা হচ্ছে। অবৈধভাবে মজুত করে বিপুল পরিমাণ তেল গভীর সমুদ্রে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে। সরকারিভাবে নতুন দাম ঘোষণার পরই এই তেল বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করছে সিন্ডিকেট। বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সয়াবিন তেলের পাইকারি বাজার রাজধানীর মৌলভীবাজারের দুইজন বড় তেল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বাস্তবে দেশে তেলের কোনো সংকট নেই। কোম্পানিগুলো এবার রোজায় সরকারিভাবে তাদের চাহিদামতো খুচরা মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনি। তেলের বাজার নিয়ন্ত্রকারী প্রভাবশালী মহল প্রথমে চেয়েছিল লিটারে ২০ টাকা বাড়াতে। কিন্তু সরকার ৮ টাকা বাড়িয়ে প্রতি লিটারের দাম নির্ধারণ করে দেয় ১৭৫ টাকা। এতে তারা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়। এজন্য এখন আবার লিটারে ১৫ টাকা বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। মূলত তাদের চাহিদা অনুযায়ী দাম না বাড়ালে বাজারে সরবরাহ লাইন কখনো স্বাভাবিক হবে না। তারা বলেন, বাজারে যে সয়াবিন তেলের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, এটি আসলে কৃত্রিম। বিপুল পরিমাণ তেল সাগরে বিশেষ কৌশলে মজুত করা হয়েছে। তাদের জানামতে, মাদার ভেসেল থেকে খালাস করে বিপুল পরিমাণ তেল লাইটার জাহাজে মজুত রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে পর্দার আড়ালে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট অনেকে জড়িত। কিন্তু কেউ তা স্বীকার করবে না। ঈদের আগে লিটারে তেলের দাম বাড়ানোর পর ঠিকই এসব তেল খালাস করে সরবরাহ লাইনে ঢুকানো হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লাইটার জাহাজকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করে পণ্যমূল্য বাড়ানোর সুযোগ ঠেকাতে ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি সার্কুলার জারি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য লোডের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বন্দর সীমানা ত্যাগ করতে হবে। সার্কুলারে আরও বলা হয়, মাদার ভেসেলকে গুদাম বানিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং মূল্য বৃদ্ধি করা রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সার্কুলারই প্রমাণ করে যে লাইটার জাহাজে তেল মজুত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, কয়েক বছর আগেও ১২ থেকে ১৪টি কোম্পানি তেল আমদানি করত, যা এখন মাত্র ৪-৫টিতে নেমে এসেছে। কিন্তু দেশে কী পরিমাণ তেল প্রয়োজন এবং কতটুকু আমদানি হচ্ছে, তা সঠিকভাবে মনিটরিং করতে ব্যর্থ হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, মন্ত্রণালয় ও আমদানিকারকদের মধ্যে কোনো বোঝাপড়া আছে কিনা, নাকি বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের উদাসীনতা রয়েছে। এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া গেলে তেল মজুতের আসল রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।
বাংলাদেশ লাইটার শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি মোহাম্মদ নবী আলম বলেন, আমদানিকারকরা ভোগ্যপণ্যে কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য লাইটার জাহাজগুলো গুদাম বানিয়েছে। বছরের অন্যান্য সময় সীমিত পরিমাণে ভোগ্যপণ্যের আমদানি হওয়ায় আমদানিকারকরা দ্রুত পণ্য খালাস করতেন। এখন রমজান আসায় পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, পাশাপাশি আমদানিও অনেক বেড়েছে। তাই লাইটার জাহাজের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু জাহাজেই পণ্য মজুত করে রাখায় অন্যান্য পণ্য পরিবহণে সমস্যা হচ্ছে।
লাইটার জাহাজসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ১,৮০০ লাইটার জাহাজ পণ্য পরিবহন করছে। তবে আমদানিকারকরা পণ্য খালাস না করে প্রায় ২০ শতাংশ লাইটার জাহাজকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। এতে প্রায় ৩৬০ লাইটার জাহাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় নৌপথে সিমেন্ট, বালু, ক্লিংকারসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহনে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন অভিযোগ করেন, ফের সরকারিভাবে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর জন্য কোম্পানিগুলো কারসাজি করছে। এখনো বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়নি। তিনি জানান, মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য মজুত রেখে পরে গুদামে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা ঈদকে সামনে রেখে বিপুল অঙ্কের মুনাফা লুটতে সহায়ক হবে।
এ সংকট নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনও উদ্বিগ্ন। বিষয়টি মোকাবিলায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে চার দফায় বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ মঙ্গলবার টাস্কফোর্সের সভায় ডিসি ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সতর্ক করেন এবং বাজারে স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।
ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনষ্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের দাম সময়ে সময়ে বৈশ্বিক বাজার ও অভ্যন্তরীণ খরচের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা। এখন তা ১৫ দিন পরপর সমন্বয় করার কথা। বৈশ্বিক বাজারে তেলের দর, আমদানি খরচ, পরিবহণ ও বিভিন্ন ধাপে সরকারের ভ্যাট যুক্ত করে সয়াবিন তেলের দর নির্ধারণ করা হয়। আমরা বলেছি সরকারের নীতিমালা মেনেই দর সমন্বয় করতে। তবে সরকার রোজায় পণ্যটির দাম বাড়াতে চাইছে না। সেজন্য রোজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভ্যাট ছাড় অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন, এর মধ্যে রমজানে চাহিদা ৩ লাখ টন। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত দেশে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৮ টন তেল আমদানি হয়েছে, পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদন ২ লাখ ৫০ হাজার টন। আমদানির পরিমাণ এখনো পাইপলাইনে রয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬৫ টন। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য নিম্নমুখী হওয়ায়, স্থানীয় বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা ছিল। তবে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিন তেলের দাম উল্টো বাড়ছে।
**রোজার আগেই বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও
**ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাইস ব্র্যান তেল রপ্তানিতে ২৫% শুল্ক
**বন্দর থেকে পণ্য নিতে দেরি করলে তিনগুণ জরিমানা
**ভোজ্যতেলে অব্যাহতির মেয়াদ ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়লো