বিগত ১৫ বছরে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। যার সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকা। তিন শ্রেণির সমন্বিত একটি চক্র এসব অর্থ লোপাট করেছে। এর মধ্যে আছেন মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক; আমল্লা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বুধবার (১০ অক্টোবর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংল্লাদেশ (টিআইবি) রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে আসে।
টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুসারে সওজে প্রকল্প ব্যয় হয়েছে ১ ল্লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভ‚মি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি সেবা বাবদ খরচ হয়েছে ২৫ শতাংশ। আর বাকি ৭৫ শতাংশ খরচ হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে। এই ৭৫ শতাংশ থেকে ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে ২৩-৪০ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে। ২৩ শতাংশ ধরে দুর্নীত হয়েছে ২৯ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এবং ৪০ শতাংশ ধরে দুর্নীতি হয়েছে ৫০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ত্রিমুখী যোগসাজশে সড়ক ও মহাসড়কে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে অর্থাৎ রাজনীতিবিদ, আমল্লা ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে এই দুর্নীতি হয়েছে। স্বার্থের কারণেই এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এখান থেকে উত্তরণে স্বার্থের দ্ব›দ্ব নিরসনে আইন করা দরকার। এমন আইন করে তা বাস্তবায়ন করলে পরিস্থিতি অনেকাংশে উন্নত করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়া ম্যানুয়াল থেকে অটোমেশন হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। অনিয়ম ও দুর্নীতির ধরন বেড়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। এটা ছাড়া পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে বাংল্লাদেশে চার লেনের সড়ক নির্মাণে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১ থেকে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত নির্মাণ খরচ বেশি। যেটা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ২ থেকে ৯ গুণ বেশি; ইউরোপের চেয়ে দুই গুণ বেশি। আমরা সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের নানা প্রকল্পের তথ্য চাইতে গেলে অনেক তথ্য আমাদের দেওয়া হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, যেসব তথ্য প্রকাশযোগ্য, সেগুলো যেন প্রকাশ করা হয়। তবে বাস্তব কথা হলো প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার তো পরিবর্তন হয়নি। তাই রাতারাতি পরিবর্তন আশা করছি না। এছাড়া তাদের গবেষণা প্রতিবেদন শুধু দেশীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতেও কমবেশি দুর্নীতি হয়েছে। দেশীয় আমল্লাতন্ত্রের সঙ্গে বিদেশি আমল্লাতন্ত্রের যোগাসজশ হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সড়ক ও সেতু খাতে সরকারের অর্থ বরাদ্দ ছিল ১ ল্লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মোট খরচের ৭২ শতাংশ কাজ পেয়েছে ১৫টি ঠিকাদার। প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারদের ল্লাইসেন্স ভাড়া নেওয়া, কোনো ঠিকাদারের প্রাপ্ত কার্যাদেশ কিনে নেওয়া, নিয়মের বাইরে উপঠিকাদার নিয়োগ (সাবকন্ট্রাক্ট), প্রতিযোগী ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কার্যাদেশের অর্থমূল্যে ২ থেকে ৬ শতাংশ দুর্নীতি হয়। আর নির্মাণকাজের কার্যাদেশ পাওয়া ও ঠিকাদারকে বিল পেতে ঘুস বরাদ্দের পরিমাণ ১১ থেকে ১৪ শতাংশ এবং নির্মাণকাজে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের দুর্নীতির হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ।
টিআইবি’র গবেষণা বলছে, ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎকালীন মন্ত্রী, কয়েকজন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। এর ফলে ঠিকাদারেরা নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করেছেন। উপকরণ যতটুকু দরকার, তার চেয়ে কম ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশলীরা এই অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছেন। একটি প্রকল্পে বৃক্ষরোপণ বাবদ ৭৪ ল্লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু একটি গাছও না ল্লাগিয়ে বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
টিআইবি জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ও ঠিকাদারেরা সরাসরি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুক‚ল্য পাওয়ায় নিম্নমানের কাজ করা বা প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির জন্য তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। কয়েকজন ঠিকাদারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত নেই। কিছু ঠিকাদারের রাজনৈতিক প্রভাব ও উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জালিয়াতি করায় গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ৩৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তবে ২৬টি প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই নিম্নমানের প্রকল্প প্রস্তাব ও ফরমায়েশি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের নজিরও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প অনুমোদন সভায় দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তাব উত্থাপন এবং গোপনে প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করতে সওজের কোনো কোনো কর্মকর্তা পরিকল্পনা কমিশনের কিছু কর্মচারীকে ২ ল্লাখ থেকে ১০ ল্লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস দিয়েছেন। প্রকল্প নেওয়ার সময় অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়। কখনো কখনো প্রাক্কলিত বাজেটের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দাঁড়ায়। বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে এল্লাকাভিত্তিক বড় বৈষম্যের চিত্রও উঠে এসেছে। দেখা গেছে, শেষ চার অর্থবছরে অঞ্চলভিত্তিক খারাপ সড়কের তুলনায় গড়ে খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বরাদ্দের হার খুবই কম এবং সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অধিক বরাদ্দ এবং গত দুই অর্থবছরে কুমিল্লায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ ও কমিউনিকেশন) তৌহিদুল ইসল্লাম। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের। সড়কের অনিয়ম ও দুর্নীতির গবেষণাটি করেছেন টিআইবির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন ও গবেষণা সহযোগী মো. মোস্তফা কামাল।