সড়কে নেই শুল্কমুক্ত সুবিধার ৪২৫ ট্যাক্সিক্যাব

** ২০১৪ সালে দুই কোম্পানি ৪২৫টি হলুদ ট্যাক্সিক্যাব নামিয়েছিল, যার মধ্যে ৪০০টি মেয়াদোত্তীর্ণ
** শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ি গাইডলাইন অনুযায়ী রূপান্তর করা হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়িতে

রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরে কয়েক বছর আগে জনপ্রিয় হওয়া হলুদ ট্যাক্সিক্যাব এখন উধাও হয়ে গেছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ি দিয়ে এই সেবা চালু করেছিল দুটি কোম্পানি। ওই ট্যাক্সিক্যাব-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৩ সালের পর হলুদ ট্যাক্সিক্যাবের চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ার চালুর পর এই সেবা ভাড়ার ব্যবধানের কারণে প্রতিযোগিতাও করতে পারছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, দুটি কোম্পানি সড়কে যে ৪২৫টি হলুদ ট্যাক্সিক্যাব নামিয়েছিল, সেগুলোর ৪০০টির ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে গেছে। একটি সূত্র বলেছে, ট্যাক্সিক্যাব হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়িগুলো রেজিস্ট্রেশন বদলে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর হয়ে সড়কে চলছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএ-এর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, দুটি কোম্পানিকে ট্যাক্সিক্যাব পরিচালনার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেসব ট্যাক্সিক্যাবের ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে গেছে, সেগুলো আর সড়কের চলাচল করে না। তবে আবার ট্যাক্সিক্যাব সেবা চালুর পরিকল্পনা আমাদের আছে।

বিআরটিএর সূত্র জানায়, ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস পরিচালনার জন্য তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেড এবং আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে মোট এক হাজার ৩০০ গাড়ি আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। শুল্কমুক্ত সুবিধায় ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠান দুটি হলুদ ওই ট্যাক্সিক্যাব আমদানি করে। সব মিলিয়ে তারা সড়কে ৪২৫টি ক্যাব নামাতে পেরেছিল। এগুলোর মধ্যে তমার ছিল ২৫০টি। যাত্রীরা মোবাইলে কল দিয়েও এই ক্যাব ভাড়া করতে পারতেন। এই ট্যাক্সিক্যাব বেশি চলত ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিমানবন্দর এলাকায়। ভাড়া নির্ধারিত থাকায় যাত্রী হয়রানির অভিযোগ তেমন পাওয়া যায়নি।

ট্যাক্সিক্যাব গাইডলাইন-২০১০ অনুযায়ী, ১৫০০ সিসির ট্যাক্সিক্যাবের ইকোনমিক লাইফ ১০ বছর, ২০০০ সিসির ঊর্ধ্বে হলে ১২ বছর। হলুদ ট্যাক্সিক্যাবগুলোর সবই ছিল ১৫০০ সিসির। সে অনুযায়ী, প্রায় ৪০০ গাড়ির ইকোনমিক লাইফ ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। তবে করোনার সময় চলাচল বন্ধ থাকায় কোম্পানির অনুরোধে সড়কে চলার মেয়াদ এক থেকে দুই বছর বাড়ানো হয়।

ট্যাক্সিক্যাব হিসেবে মেয়াদ শেষে রূপান্তর হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়িতে

সূত্রমতে, ট্যাক্সিক্যাব হিসেবে গাড়িগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সেগুলোকে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর করছে। ট্যাক্সিক্যাব গাইডলাইনে এ সুযোগ রয়েছে। গাইডলাইনে বলা হয়েছে, ‘ট্যাক্সিক্যাবের মেয়াদ শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত শুল্ক এবং প্রযোজ্য অন্যান্য কর পরিশোধ করে ট্যাক্সিক্যাবকে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের অনুমতি দেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা হবে। তবে বিক্রীত গাড়ি কোনো অবস্থাতেই আর ট্যাক্সিক্যাব হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ট্যাক্সিক্যাব হিসেবে ওই গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন ছিল ‘প’ শ্রেণির। বিআরটিএতে এখন মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে ‘গ’ শ্রেণিতে।
Taxi Service Dhaka
বিআরটিএর সূত্র জানায়, তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেড ৬৫০টি ট্যাক্সিক্যাব চালানোর অনুমোদন নিলেও সড়কে নামিয়েছিল ২৫০টি। সব কটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় কোম্পানিটি এগুলোকে ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তর করেছে। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টও ৬৫০টি ট্যাক্সিক্যাব আমদানির অনুমতি নিয়ে সড়কে নামিয়েছিল ১৭৫টি। এর মধ্যে ১৫০টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। বাকি ২৫টির মেয়াদ আছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। মেয়াদোত্তীর্ণ ১৫০টির মধ্যে ৫৭টির কনভার্সন (রূপান্তর) করার জন্য কাস্টম ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৯৭টিও ব্যক্তিগত গাড়িতে রূপান্তরের কার্যক্রম চলছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএ-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইকোনমিক লাইফ শেষ হলে চলাচলের যোগ্য ট্যাক্সিক্যাব প্রতিস্থাপনের জন্য মালিক কোম্পানি আবেদন করলে তাঁরা তা যাচাই করে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষ প্রযোজ্য ‘ফি’ নির্ধারণ ও আদায় নিশ্চিত করার পাশাপাশি রেয়াতি শুল্কে আমদানি করা ট্যাক্সিক্যাবের ক্ষেত্রে এনবিআরের নির্ধারিত শুল্ক ও প্রযোজ্য অন্যান্য কর আদায় নিশ্চিত করবে। তারপর ইকোনমিক লাইফের মেয়াদ শেষ হওয়া ট্যাক্সিক্যাবের রেজিস্ট্রেশন নম্বর বাতিলের ব্যবস্থা করে। তারপর আগের রেজিস্ট্রিকৃত কোম্পানির নামে একটি ট্যাক্সিক্যাবের পরিবর্তে আরেকটি ট্যাক্সিক্যাব রেজিস্ট্রেশন দেয়। সড়কে ট্যাক্সিক্যাব সেবা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না: ১৯৯০-এর দশক থেকে রাজধানীতে ট্যাক্সিক্যাব সেবা চালু হলেও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফলে যাত্রীরাও এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তমা কনস্ট্রাকশনের সাবেক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থ্রি-হুইলার সিন্ডিকেটের কারণে মাঠে ট্যাক্সিক্যাব টিকতে পারেনি। সবশেষে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের কারণে ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস হারাতে বসেছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘পুরো বিশ্বেই ট্যাক্সিক্যাব একটি জনপ্রিয় গণপরিবহন ব্যবস্থা। সেটা আমাদের দেশে হোঁচট খেয়েছে এবং অনেকটা জাদুঘরে চলে গেছে। এই সার্ভিসকে ব্যবসাবান্ধব, জনপ্রিয় এবং যাত্রীবান্ধব করার উদ্যোগে দুর্বলতা ছিল।’

ট্যাক্সিক্যাব গাইডলাইন-২০১০-এ কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বিআরটিএ। শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, নতুন গাইডলাইন চূড়ান্ত হলে আবার ট্যাক্সিক্যাব নামানোর বিষয়ে ভাবা হবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, আগে ট্যাক্সিক্যাব চলত ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং শহরতলি এলাকায়। নতুন গাইডলাইনের খসড়ায় এর পরিধি বাড়িয়ে খুলনা, সিলেট, বরিশালসহ বিভাগীয় শহরগুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগের গাইডলাইনে একটি কোম্পানিকে ট্যাক্সিক্যাব চালাতে হলে ন্যূনতম এক হাজার গাড়ি থাকার নিয়ম ছিল। নতুন গাইডলাইনের খসড়ায় এটি কমিয়ে ৫০০ করা হয়েছে। একটি কোম্পানির ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ও সর্বনিম্ন ৫০০ ক্যাব থাকতে হবে। চট্টগ্রাম মহানগরের জন্য সর্বোচ্চ ১ হাজার, সর্বনিম্ন ৩০০। সিলেট, খুলনা ও বরিশালের জন্য সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ায় ঢাকা মহানগরে সব কোম্পানি মিলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ট্যাক্সিক্যাব চলাচলের অনুমতি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৫ হাজার, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে সর্বোচ্চ ১ হাজার। খসড়ায় বলা হয়েছে, ট্যাক্সিক্যাবের একটি নিজস্ব অ্যাপ থাকবে। সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ট্যাক্সিক্যাবে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে এবং নতুন করে ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করা হবে। ভাড়ার হার বাড়ানোর এবং রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ বেশি ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ট্যাক্সিক্যাবে সার্ভিস গাইডলাইন প্রয়োগ এবং সার্ভিসের মান উন্নয়নের জন্য পরামর্শ ও সুপারিশ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি স্থায়ী কমিটি থাকবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!