২৪টি বিশ্বের নামিদামি বিলাসবহুল গাড়ি। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করেছেন দ্বাদশ সংসদের সংসদ সদস্যরা। কিন্তু খালাস করার আগেই জুলাই অভ্যূত্থানে সরকারের পতন হয়। পালিয়ে যান সব সংসদ সদস্য। এই বিলাসহুল গাড়ি নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। ১০ কোটি টাকার গাড়ির দর পড়ে নামেমাত্র। কোনো গাড়ি ৫০ হাজার, এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা। নজর পড়ে সিন্ডিকেটের। শেষে কাস্টম হাউস নিলাম স্থগিত করে। তবে এসব নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিলামের পরিবর্তে নতুন কৌশলে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান শুক্রবার (২৫ জুলাই) চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা গাড়িগুলো নিলামে দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। এখন বিকল্প কিছু ভাবছি। কিছু সরকারি সংস্থা প্রস্তাব দিয়েছে, তারা গাড়িগুলো ৬০ শতাংশ দামে কিনতে আগ্রহী। তবে আমরা জলের দামে এগুলো বিক্রি করতে চাই না। প্রতিটি গাড়ির মূল্য ৮ থেকে ৯ কোটি টাকা পর্যন্ত। তাই উপযুক্ত দাম না পেলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে বিকল্প ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বছরের পর বছর ফেলে রেখে স্ক্র্যাপে পরিণত করার পক্ষপাতী নই। দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় এসব বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছিলেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর গত বছরের ৬ আগস্ট সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে এনবিআর সেই সুবিধা বাতিল করে। ফলে এমপিরা গাড়িগুলো ফেলে রেখে যান। মোট ৪২টি গাড়ির মধ্যে ২৪টি গাড়ি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম দফায় নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টমস। তবে সেখানে সর্বোচ্চ দর ছিল ১ লাখ থেকে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকার মধ্যে, যা বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক কম। দর সন্তোষজনক না হওয়ায় গাড়িগুলো বিক্রি করা হয়নি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বন্দরে ৬ হাজার কনটেইনার দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। এগুলো নিলামে তুলে বন্দরের জট নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে একটি নিলামের আয়োজন হয়েছে। প্রথম নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতাকে আমরা দিয়ে দেব। নিলাম করতে করতে যাতে সময় নষ্ট না হয় সে জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
অপরদিকে হাউসের কর্মকর্তা ও অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠকে চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রামে আইসিডি বেইজড একটি নতুন কাস্টম হাউস গঠন করা হবে। আগামী আগস্ট মাসে এ বিষয়ে সরকারি আদেশ আসবে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বর্তমান ভবন ভেঙ্গে নতুন ভবন করা হবে। এই সময়ে চট্টগ্রামে আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে কয়েক বছরের জন্য কাস্টম হাউসের কার্যক্রম স্থানান্তর করা হবে।’ এসময় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের জটিলতার কারণে এর ব্র্যান্ড ভ্যালু কমে গেছে। তাই আমরা নতুন মডার্ন টেকনোলজি ডেভেলপ করব আগামী দুই বছরের মধ্যে।’
বৈঠকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের প্রধান স্টেকহোল্ডার সিএন্ডএফ এজেন্টরা বন্দর, আইসিডি থেকে পণ্য খালাসে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এ সময় এনবিআর চেয়ারম্যান সৎ এবং ভালো ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার আশ্বাস দেন। শুল্কায়নে নতুন সফটওয়্যারের বিষয়ে এনবিআর চেয়ারসম্যান বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যারা অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম ব্যবহার না করে অন্যান্য যেসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে শুল্কায়ন করে আমরা সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে মডার্ন টেকনোলজি এনে আমরা নতুন সফটওয়্যার তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে কোনো অবস্থাতেই সফটওয়্যার স্লো না হয়। কাজের ব্যাঘাত না ঘটে। শুরুতে কয়েকটি শুল্ক স্টেশনে পরীক্ষামূলকভাবে এই প্রয়োগ করব। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের ব্র্যান্ড ভ্যালু অনেক কমে গেছে। আমাদের ব্যবহারকারীরা এই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে গিয়ে বারবার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। যে সময় কাজের ব্যাঘাত হয়েছে সেটি সহনীয় সময় নয়।’
আবদুর রহমান খান বলেন, ‘চট্টগ্রামে আমরা তিনটি আইকনিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নতুন ভবন। এই ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে। ভবন নির্মাণ শুরু হলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কার্যক্রম আগ্রবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে স্থানান্তর করা হবে। ভবন নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কার্যক্রম ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারে পরিচালনা করা হবে। সব ব্যবসায়ীর আগ্রাবাদ বেইজড অফিস। সুতরায় কাস্টম হাউসের কার্যক্রম কয়েক বছরের জন্য স্থানান্তর হলে ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবে। এছাড়া কাস্টম একাডেমিতে নতুন একটি ভবন নির্মাণ করা হবে। আগ্রাবাদে নির্মাণ করা হবে নতুন কর ভবন। শিগগিরই এই তিনটি ভবনের কাজ শুরু হবে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘অফডককে জনপ্রিয় করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর চাচ্ছে বন্দর থেকে শতভাগ ডেলিভারি কার্যক্রম আইসিডি থেকে দেওয়ার জন্য। এটি নৌপরিবহন উপদেষ্টা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের চাওয়া। প্রায় ৭ হাজার এইচএস কোডের পণ্য ডেলিভারি দেওয়া হয়। এর মধ্যে মাত্র ৬৬ টি আইটেমের পণ্য ডিপো থেকে ডেলিভারি দেওয়া হয়। কভিডের সময় শতভাগ মালামাল আইসিডি থেকে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে।’
সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এস এম সাইফুল আলাম এবং সেক্রেটারি জেনারেল শওকত আলী বলেন, ‘আইসিডিতে ক্যাপাসিটি সমস্যা রয়েছে। তারা বন্দর, এনবিআরকে আরও বেশি আমদানি পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার অনুমতি চেয়ে অ্যাপ্রোচ করলেও প্রকৃত পক্ষে সেই সক্ষমতা নেই। ফলে আমদানি পণ্য ডেলিভারি নিতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়। তাই আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও আইসিডিগামী আমদানি পণ্য ডেলিভারিতে ডুয়েল পারমিশানের অনুমোদন চাই।’
এর জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইসিডির ক্যাপাসিটি না থাকলে সেটি আইসিডি মালিকরা বলবে। বন্দরের আমদানি পণ্য হ্যান্ডিলিংয়ে আাইসিডির ক্যাপাসিটি কতটুকু, এ বিষয়ে তারা কতটুকু সক্ষম প্রয়োজনে আমরা আইসিডি মালিকদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করব। সব ধরনের পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নিয়ে আসার প্রয়োজন কী? মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর দিয়েও পণ্য আমদানি করা যায়। মোংলা বন্দরের সঙ্গে এখন কানেকটিভিটি অনেক ভালো। পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা বন্দরের পণ্য সারা দেশে পৌঁছানের সুযোগ সহজ হয়েছে।’
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘অহেতুক ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা যাবে না। আমাদের মূল ফোকাস থাকবে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন। যারা কর ফাকি দিয়ে জনগণকে ঠকাবে তাদের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নেব। ব্যবসায়ীরা যাবে বিড়ম্বনার শিকার না হয় সেটি হবে আমাদের মূল প্রতিপাদ্য।’
মতবিনিময় সভায় এনবিআর সদস্য মো. মোয়াজ্জম হোসেন, কাজী মোস্তাফিজুর রহমান, মুহাম্মদ মুবিনুল কবীর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার শফি উদ্দিনসহ কাস্টম কর্মকর্তা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।