এনবিআর ‘রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা’-এই দুই ভাগে ভাগ হচ্ছে। দুইটি বিভাগ হলে নিজের কর্মের পরিধি, কর্মে নতুনত্ব যোগ হবে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এমন আশার সঞ্চার হয়েছে। দুইটি বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন নিজেদের ক্যাডারের (কাস্টমস-ভ্যাট ও আয়কর) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। এক বুক আশা নিয়ে কর্মকর্তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভাগ ভাগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রস্তাবনাও দিয়েছেন। কিন্তু অধ্যাদেশের অনুমোদিত খসড়া দেখে হতভম্ব কর্মকর্তারা। কারণ তাদের প্রস্তাবনার বেশিরভাগ খসড়ায় নেই। বিশেষ করে দুইটি ক্যাডারের (কাস্টমস-ভ্যাট ও আয়কর) বাইরে থেকে দুইটি বিভাগের সচিব নিয়োগ করার বিষয় খসড়া উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আরো বেশ কিছু মৌলিক জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার ফলে দুইটি বিভাগ করা হলে যে উদ্দেশ্যে এনবিআর সংস্কার বা দুইভাগ করা হচ্ছে, তা পূরণ হবে না। বরং এনবিআর একটি বিশেষ ক্যাডারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে বলে মনে আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
খসড়া অধ্যাদেশ অনেকটা তড়িঘড়ি করে মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। বিষয়টি জেনে যায় কাস্টমস-ভ্যাট ও আয়কর ক্যাডার কর্মকর্তারা। ক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। বিকেল থেকে আগারগাঁও এনবিআর ভবনে জড়ো হন কয়েকশত ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের রুমের সামনে অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেষে সন্ধ্যার দিকে এনবিআর চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়। নবীন ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়েন চেয়ারম্যান। কর্মকর্তাদের ক্ষোভের মুখে চেয়ারম্যান আইন সচিবকে ভেটিং পাস না করানোর অনুরোধ জানান। একইসঙ্গে বুধবার (৩০ এপ্রিল) অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দুই ক্যাডারের (কাস্টমস-ভ্যাট ও আয়কর) অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বৈঠক করে খসড়া পাসের আগেই সংশোধনের ব্যবস্থা করবেন বলেন আশ্বাস দেন চেয়ারম্যান। আশ্বাসের পরও কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘অবিশ্বাস’ তৈরি হয়। কারণ তাদের অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
অবশেষে বুধবার সকাল থেকেই অনেকটা কর্মবিরতি দিয়ে এনবিআরে জড়ো হন কয়েকশত ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আলোচনার মধ্য দিয়ে এই এক ঝাঁক মেধাবী কর্মকর্তার সময় কাটে এনবিআরে। বিকেলে দুই অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। সন্ধ্যায় ফিরে শত শত কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক শুরু হয় এই কর্মকর্তাদের। সেখানে অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ও সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে গভীর উদ্বেগে থাকা কর্মকর্তারা জানতে চান, ভেটিং সত্যিকারে বন্ধ হয়ে কিনা। অধ্যাদেশ পাস হয়ে গেছেন কিনা। কর্মকর্তাদের অন্ধকারে রেখে আবারো মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে কিনা। তারা যে স্বপ্ন নিয়ে এনবিআরে যোগদান করেছেন-তা বাস্তবায়ন হবে কিনা।
ক্ষুদ্ধ কর্মকর্তারা জানতে চান, অর্থ উপদেষ্টা প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে ‘স্পষ্ট’ বলে দিয়েছেন ‘এনবিআর সেপারেশনের বিষয়ে আপনারা কতগুলো সুন্দর প্রস্তাবনা দিয়েছেন। অধ্যাদেশ হয়ে গেছে। এখন তো আর কিছু করতে পারবো না। তবে কিছু কিছু বিষয় বাস্তবায়নের সময় তা দেখবো।’ অর্থ উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছেন অধ্যাদেশ হয়ে গেছে। তাহলে আপনারা কি বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। জবাব বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও এনবিআর সদস্য (কাস্টমস: নিরীক্ষা ও আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উপদেষ্টার সঙ্গে খসড়া অধ্যাদেশের প্রত্যেকটা লাইন নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। খসড়ায় আমাদের কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে-তা তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছি। তিনি সুন্দর একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সসেশন) অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও কর কমিশনার ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা সবাই একই লাইনে আছি, একই পরিবারের সদস্য। আমরা কেউ বিচ্ছুত নই। আমরা উপদেষ্টার সঙ্গে বসার পর বলেছি আমরা কোথায় কি কি পরিবর্তন চায়। এক কথায় তাঁর সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রুসু হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, বাস্তবায়নের আগে আমরা যে সংশোধনীর কথা বলেছি তা করবেন। আমরা প্রতিটি পয়েন্ট ধরে আলোচনা করেছি যে আমরা কি চায়। কোন কোন জায়গায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কোন কোন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, কোন কোন জায়গায় একটি ক্যাডারের উপর আরেকটি ক্যাডার বা একটি বিভাগের উপর আরেকটি বিভাগের কর্তৃত্ব করার সুযোগ তৈরি করছে। আলোচনা শেষে উপদেষ্টা বলেছেন, অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের পূর্বে তা অধিক সংশোধনের ব্যবস্থা নেবেন। এর মধ্যে এনবিআরের সদস্য পর্যায়ে যে কর্মকর্তা আছেন, তাদের পদসংখ্যা কোনভাবেই কমবে না। আরো বৃদ্ধি করা হবে এবং সবগুলো সচিব পদমর্যাদার করা হবে। সচিব মর্যাদার যারা রয়েছেন, তারা গ্রেড-১ হবেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি-তাহলো প্রশাসন অনুবিভাগের অন্যান্য ক্যাডারের টার্ম থাকবে। সেখানে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এখন আমরা যেভাবে আছি, তা আমাদের মধ্য থেকে হবে। এখন যে কাঠামোতে কাজ করছি, সে কাঠামো বজায় থাকবে। ব্যবস্থাপনা বিভাগের সর্বোচ্চ পদটি আমাদের জন্য নিশ্চিত করবেন তিনি। উপদেষ্টা বলেছেন, তোমরা যদি চাও তাহলে অধ্যাদেশ আমি ফেলে রাখতে পারি। যাতে পরবর্তী সরকার এসে করবে, ফেলে রাখার সুযোগ আছে। তবে বক্তব্যের মধ্যেই কর্মকর্তারা সমস্বরে বলে উঠেন, ‘সংশোধন নয়, অধ্যাদেশ বাতিল করতে হবে। আর সংশোধন হলে আমরা যেভাবে চেয়েছি, সেভাবে করতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারমুক্ত হতে হবে। আমরা আর বিশ্বাস করি না। আর সংশোধন করতে হলে ভেটিংয়ের পূর্বেই তা করতে হবে।’ জবাবে ফারুকী বলেন, আমাদের বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আরো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে ‘কমিটমেন্ট’ করেছেন, যা আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। আমাদেরকে নিয়ে উপদেষ্টা সংশোধনের কাজটি করবেন বলে বলেছেন। সিভিল সার্ভিস (ট্যাক্সসেশন) অ্যাসোসিয়েশনের শনিবার (৩ মে) ইজিএম-এ প্রত্যেক ব্যাচ থেকে খসড়ার যেসব পরিবর্তন করতে হবে, তার উপর আলোচনা করার অনুরোধ জানান।
অপরদিকে, দুই অ্যাসোসিয়েশনের দুই প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পরও কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়ে যায়। তাদের মধ্যে আরো বেশি অসন্তোষ তৈরি হয়, অবিশ্বাস যেন আরো ঝেঁকে বসে। কারণ তাদের বেশিরভাগ প্রশ্নের কোনো ‘ষ্পষ্ট’ উত্তর তারা পায়নি। অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা স্পষ্ট উত্তর না দিয়েই সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করেন। পরে কর্মকর্তাদের মধ্যে আরো বেশি ক্ষোভ তৈরি হয়। শেষে কর্মকর্তাদের ক্ষোভের মুখে দুই অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আবার সম্মেলন কক্ষে কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হন। সেখানে কয়েকজন কর্মকর্তা স্পষ্ট করে জানতে চান, আসলে অধ্যাদেশ সংশোধন হবে কিনা। অধিকার আদায় করতে আসা কর্মকর্তারা শেষে কোনো হয়রানির শিকার হবেন কিনা-তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানান। কারণ অতীতে অধিকার আদায় করতে এসে এমন ব্যক্তিগত হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জবাবে ফারুকী কর্মকর্তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, দাবি আদায়ে আমরা সোচ্চার থাকবো। ইজিএম দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো-আমাদের কর্তৃপক্ষ যেন বুঝতে পারেন যে, আমাদের কি ধরনের বোধ হচ্ছেন, অসন্তোষ হচ্ছেন। কিভাবে আমাদের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে। আমি উপদেষ্টাকে বলেছি, এই ডিপার্টমেন্টে অনেক মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা রয়েছেন। অভিভাবক হিসেবে তাদের প্রতি ন্যায় বিচার করতে হবে। উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন।
** খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে কর্মকর্তাদের অসন্তোষ, কর্মসূচি
** সচিব নিয়োগে ‘মতামত’ উপেক্ষিত, নাখোশ কর্মকর্তারা
** আয়কর-কাস্টমসের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষোভ!