দেশের শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার মো. মোহসিন চৌধুরী আইন ভেঙে নিজ নামে সরাসরি শেয়ার লেনদেন করেছেন। তিনি বর্তমানে বিএসইসির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত এবং গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের আওতাধীন ‘জিরো ওয়ান লিমিটেড’ নামে একটি ব্রোকারেজ হাউজে তার সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্টের (নম্বর: ১২০৪১৫০০৭৪৫১৮৭৩৪) অস্তিত্ব মিলেছে, যার ট্রেডিং কোড ৪৬৩। এর আগে বিএসইসির নিম্নপদস্থ কিছু কর্মকর্তা শেয়ার লেনদেনে যুক্ত ছিলেন বলে জানা গেলেও, কোনো কমিশনার নিজ নামে শেয়ার ব্যবসায় জড়িত—এমন ঘটনা এবারই প্রথম প্রকাশ্যে এলো। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই বিস্ফোরক তথ্য।
অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে যে, মো. মোহসিন চৌধুরীর নামে থাকা বিও অ্যাকাউন্টে বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের ২ হাজার ২৩১টি শেয়ার রয়েছে। যদিও বাজারের অন্যান্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার থেকে ফ্লোর প্রাইস (মূল্যপতনের নিম্নসীমা) প্রত্যাহার করা হয়েছে, বেক্সিমকোর ক্ষেত্রে তা এখনো বহাল রয়েছে—ফলে এর শেয়ারের দাম কমার সুযোগ নেই। বেক্সিমকোর পাশাপাশি তিনি আরও আটটি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করেছেন। বিষয়টি আইন, সিকিউরিটিজ বিধিমালা এবং নৈতিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে শেয়ারবাজারের ক্রমাবনত পরিস্থিতি নিয়ে আজ উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিএসইসির কোনো কর্মকর্তা শেয়ার লেনদেনে অংশ নিতে পারেন না—এটি আইনবিরুদ্ধ। যদি অভিযোগটি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে তা অত্যন্ত গর্হিত ও অনৈতিক কাজ হবে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে সরকারের উচিত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, বিএসইসি কমিশনার মো. মোহসিন চৌধুরীর একটি বিও অ্যাকাউন্ট রয়েছে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের আওতাধীন ‘জিরো ওয়ান লিমিটেড’ নামের একটি ব্রোকারেজ হাউজে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা— রহিমস প্লাজা, স্মার্ট হাব, ষষ্ঠ তলা, জাকির হোসেন রোড, খুলশি, চট্টগ্রাম। ব্রোকারেজ হাউজটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৩.২/সিএসই-১০৪/২০২০/৩৩২। সেই হাউজে মোহসিন চৌধুরীর বিও অ্যাকাউন্ট নম্বর হলো ১২০৪১৫০০৭৪৫১৮৭৩৪ এবং ট্রেডিং কোড ৪৬৩।
অ্যাকাউন্টে থাকা তথ্য অনুযায়ী, মোহসিন চৌধুরীর জন্ম তারিখ ৬ জুলাই ১৯৬৪, পেশা উল্লেখ আছে “সার্ভিস”, পিতা নুরুল আলম চৌধুরী, মাতা খালেদা বেগম এবং ঠিকানা—১০৭, গরিবুল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটি, খুলশি, চট্টগ্রাম। জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দেওয়া হয়েছে ৭৭৭১৫১৫৩৫৫। ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায়, অ্যাকাউন্ট নম্বর ১০৮১৫১০০২৬২৯৯। তবে টিআইএন নম্বরের ঘরটি ফাঁকা রয়েছে।
মোহসিন চৌধুরীর শেয়ার লেনদেন সংক্রান্ত নানা দিক খতিয়ে দেখেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে তার অ্যাকাউন্টে বিতর্কিত কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার রয়েছে। ৫ আগস্টের পর সব কোম্পানির শেয়ার থেকে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করা হলেও বেক্সিমকোর ক্ষেত্রে সেই সীমা এখনো বলবৎ। এছাড়া তিনি আরও আটটি কোম্পানির শেয়ারে লেনদেন করেছেন। কোম্পানিগুলো হলো—নাভানা ফার্মা, জেএমআই হাসপাতাল অ্যান্ড মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট, মেঘনা ইন্স্যুরেন্স, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, চাটার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সিকদার ইন্স্যুরেন্স এবং ট্রাস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স। তবে বর্তমানে এসব শেয়ার তার বিও অ্যাকাউন্টে নেই।
জানা যায়, ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে বলা হয়, কমিশনের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী—নিজ, স্বামী/স্ত্রী, পিতা-মাতা, সন্তান কিংবা পোষ্যদের নামে প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি শেয়ারবাজারে কোনো ধরনের সিকিউরিটিজ লেনদেনে অংশ নিতে পারবেন না, এমনকি তাতে কোনোভাবে জড়িতও থাকতে পারবেন না। পরবর্তীতে এই নিষেধাজ্ঞা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৯৩ (সংশোধিত) এর আওতায় ইনসাইডার ট্রেডিং এর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু কমিশনার মো. মোহসিন চৌধুরী এসব বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করেই শেয়ার লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন।
উল্লেখিত অভিযোগ বিষয়ে মো. মোহসিন চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে শনিবার তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি কোনো কল রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে একই নম্বরে প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও সেখানেও কোনো সাড়া মেলেনি।