শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ২৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে বিদেশি গার্মেন্টস ও দেশীয় সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়াডিং) এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশে সরকারি শুল্কের কমপক্ষে ২৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ১০ জনের নাম উঠে এসেছে, যারা আত্মসাৎকৃত অর্থ বিদেশে পাচার করার পাশাপাশি দেশে বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি, ফসলিজমি, এফডিআরসহ বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। পুলিশ অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ইতোমধ্যে আশুলিয়া থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে। মামলার অনুসন্ধানে এসব ব্যক্তির বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার মধ্যে এক ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ায় আটটি স্থাবর সম্পত্তির মালিক।

জানা গেছে, সরকার রপ্তানিমুখী পণ্য তৈরিতে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির জন্য বিশেষ সুবিধা বা বন্ড সুবিধা প্রদান করে। গার্মেন্ট শিল্পের উন্নতির উদ্দেশ্যে এই সুবিধা দেওয়া হয়, তবে এর শর্ত হলো আমদানি করা কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না এবং এগুলো দিয়ে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করতে হবে। কিন্তু এই শুল্ক সুবিধার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন চক্র অনিয়ম করছে, আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করছে এবং শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সাভার ডিইপিজেড (ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল)-এ চীনা মালিকানাধীন মেসার্স গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি রয়েছে। তারা বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে এবং পরবর্তীতে তা রপ্তানি করে। একই কোম্পানির আরও চারটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো হলো—মেসার্স গোল্ডটেক্স লিমিটেড, মেসার্স অ্যাক্টর স্পোর্টিং লিমিটেড, মেসার্স সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডাইং ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং গ্লোবাল অ্যাটায়ার লিমিটেড। গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের অনুমোদিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে স্পিডওয়ে লজিস্টিকস লিমিটেড এবং এএফটি লজিস্টিকস লিমিটেড।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্পিডওয়ে লজিস্টিকস এবং এএফটি লজিস্টিকস নামক দুটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. খসরুল আলম। তিনি এবং তার দুই প্রতিষ্ঠানসহ আরও তিন কর্মকর্তা ও গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের ছয় কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর যোগসাজশের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছেন। গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করে এবং তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। নথি অনুযায়ী, মো. খসরুল আলম স্পিডওয়ে লজিস্টিকস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী। তিনি গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে ৫০৭টি চালানে মোট ১ কোটি ৩৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৮৭ কেজি ফেব্রিক্স আমদানি করেন এবং সেগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করে সরকারের ২৩০ কোটি ৮২ লাখ ৭২ হাজার ৫৩৬ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেন। এছাড়া, এএফটি লজিস্টিকস লিমিটেডের মাধ্যমে তিনি ৬১ চালানে ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৮ কেজি পণ্য আমদানি করেন, যার মাধ্যমে সরকারের ২৯ কোটি ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার ২১২ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেন। সব মিলিয়ে, খসরুল আলম দুটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে মোট ২৬৮টি চালানে ২৬০ কোটি ৫২ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৮ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এমন অভিযোগে আশুলিয়া থানায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলা করেছে সিআইডি। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন স্পিডওয়ে লজিস্টিকসের স্বত্বাধিকারী ও এএফটি লজিস্টিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খসরুল আলম, এএফটি লজিস্টিকস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. খায়রুল আলম, স্পিডওয়ে লজিস্ট্রিকস লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার বশির আহমেদ ও মো. রাজু কাজী।

এ ছাড়া জালিয়াতিতে জড়িত গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে অপর কর্মকর্তা যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন মেসার্স গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের গ্রুপ পরিচালক (অপারেশন) মো. তানভীর হোসেন, সিনিয়র ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) মির্জা গোলাম সাত্তার ওরফে লিটন, ডেপুটি ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) ইফফাত হাসান খান ওরফে সাব্বির, ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) ইমতিয়াজ হাসান খান ওরফে শাওন, জুনিয়র এক্সিকিউটিভ (কমার্শিয়াল) আহমেদুজ্জামান, এক্সিকিউটিভ (কমার্শিয়াল) ও মো. হোসাইনুজ্জামান ওরফে রাব্বি। প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্পিডওয়ে লজিস্টিকস লিমিটেড ও এএফটি লজিস্টিকস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার আসামিদের নামে ও তাদের বেনামে দেশে এবং বিদেশে বিপুল পরিমাণ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্পিডওয়ে লজিস্টিকস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. খসরুল আলমের নামীয় ব্যাংক হিসাবগুলোতে ১২৫ কোটি ৩৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৮ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া, তার নিজ এবং কোম্পানির নামে ৮৪টি গাড়ির তথ্যও মিলেছে। খসরুল আলমের নামে বিভিন্ন জায়গায় পাঁচটি জমির দলিল, ঢাকায় ও চট্টগ্রামে দুটি ফ্ল্যাটের দলিল এবং বরিশালের গৌরনদী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চারটি জমির দলিল রয়েছে। এছাড়া, তার নামে একাধিক বীমা পলিসি রয়েছে এবং তার প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যবসায়িক অবকাঠামোও রয়েছে।

এদিকে, খসরুল আলমের ভাই মো. খায়রুল আলমের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ছয়টি হিসাব থেকে ৬ কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮০২ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। গৌরনদী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে তার নামে পাঁচটি জমির দলিলও উদ্ধার হয়েছে। খায়রুলের নামে একটি গাড়ির মালিকানার তথ্যও পাওয়া গেছে, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-৪৩-৩৩৯৯।

অন্যদিকে, মেসার্স গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের গ্রুপ ডাইরেক্টর (অপারেশন) মো. তানভীর হোসেনের নামে দেশে এবং অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তানভীর হোসেন ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবগুলোতে ১২ কোটি ৭১ লাখ ৬৩ হাজার ৩১০ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার স্ত্রী সামীমা হোসেনের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৪৬টি হিসাবের মাধ্যমে ৬১ কোটি ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৭২৭ টাকার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া, রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও, উত্তরা, গুলশান, মোহাম্মদপুর, এবং ধানমন্ডির সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে জমি ও ফ্ল্যাট মিলিয়ে ১১টি সম্পত্তির দলিল উদ্ধার হয়েছে।

তানভীর হোসেনের নামে প্রায় ৬০ লাখ টাকার একটি হ্যারিয়ার গাড়ি রয়েছে, যার নম্বর মেট্রো-ঘ-১৭-০৬২৫। তার এবং তার স্ত্রীর নামে তিনটি সঞ্চয়পত্র এবং তিনটি এফডিআর রয়েছে, যার মাধ্যমে মোট ৫৬ লাখ টাকা জমা রয়েছে। তানভীর হোসেনের নামে অস্ট্রেলিয়ায় অন্তত আটটি সম্পত্তির তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান এখনও চলছে।

মেসার্স গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) মির্জা গোলাম সাত্তার ওরফে লিটনের নামে একটি গাড়ি রয়েছে, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-৩৪৫৯৪৫। তিনি ইউনি ট্রেড লিংকার্স নামে একটি সফটওয়্যার, গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক, যার ট্রেড লাইসেন্স ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে নেওয়া হয়েছে। গোলাম সাত্তার ও তার প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংকে ১৩টি হিসাবের মাধ্যমে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৮ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

এর আগেও গোলাম সাত্তার লিটনের বিরুদ্ধে গোল্ডটেক্স গার্মেন্টসের নামে ২০১১ সালে বিল অব এন্ট্রি নং-সি-১০২৯৮৯ অনুযায়ী, অবৈধভাবে বন্ড সুবিধায় একটি অডি-এ-৪ গাড়ি আমদানির অভিযোগ রয়েছে। গাড়িটি হাঙ্গেরি তৈরী ১৯৮৪ সিসির। তার বিরুদ্ধে আরও একাধিক অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে ৩৩০০ সিসির একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি, ছয়টি ৫৫ ইঞ্চির এলসিডি টিভি, ১৯টি ৪০ ইঞ্চি তোশিবা এলসিডি টিভি, ৯টি ৪২ ইঞ্চি তোশিবা এলসিডি টিভি, একটি এলজি-এলইডি ৫৫ ইঞ্চি টিভি, ১০টি এলজি-এলইডি ৪৭ ইঞ্চি টিভি, ৩৯টি ফটোকপিয়ার মেশিন, পাঁচটি সিডি প্লেয়ার, ১৫টি এলজি-মোশন রিমোট এবং ১৪৩ কেজি স্পেয়ার পার্টস অবৈধভাবে আমদানির অভিযোগ রয়েছে। এসব কর ফাঁকি ও জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গোলাম সাত্তার লিটনকে ১ নম্বর আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে বিচারাধীন।

অন্যদিকে গোল্ডটেক্স গার্মেন্টসের ডেপুটি ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) ইফফাত হাসান খান ওরফে সাব্বিরের নামে ‘টাসো ক্লিয়ারিং সলিউশন লিমিটেড’ নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ কোম্পানি থাকার পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ইফফাত হাসান খান ওরফে সাব্বির নিজেই। সেখানে তার শেয়ার সংখ্যা ১৭শ। সাব্বির ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি হিসাবে ৯৮ লাখ ১৫ হাজার ৭০০ টাকা লেনদেন হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিডওয়ে লজিস্টিকস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ও এএফটি লজিস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খসরুল আলম বলেন, ‘এটা নিয়ে সিআইডি গত ডিসেম্বর মাসে একটি মামলা করেছে, যা তদন্তাধীন। আমি দোষী হলে আদালত বিচার করবে। আমরা জালিয়াতিতে জড়িত নই। আমাদের আইডি তারা দেয়, তারা না দিলে সিঅ্যান্ডএফের পক্ষে পণ্য আমদানি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে গোল্ডটেক্স কোম্পানি করেছে।

নিজের নামে থাকা শতকোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার যে গাড়ি আছে, তার সবই ব্যাংক লোনে নেওয়া। আপনি ১২৫ কোটি টাকা লেনদেনের কথা বললেন, আমার ৫৬ কোটি টাকা লোন আছে। আমার জমি, ফ্ল্যাট সব লোনের টাকায় কেনা। আমার কোনো এফডিআর নেই। ডিপিএস আর ইন্স্যুরেন্স বীমা আছে।’

মেসার্স গোল্ডটেক্স গার্মেন্টস লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ (কমার্শিয়াল) মো. হোসাইনুজ্জামান ওরফে রাব্বি জানান, তিনি চায়না কোম্পানি গোল্ডটেক্স গার্মেন্টসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স অ্যাক্টর স্পোর্টিং লিমিটেডে চাকরি করেছেন। তিনি আরও বলেন, তিনি ছোট পদে চাকরি করতেন এবং এসব জালিয়াতি বা মামলার বিষয়ে বসদের সঙ্গে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেন। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন এএফটির বশীর আহমেদ। অভিযুক্ত অন্যদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

**সূত্র কালবেলা

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!