শুল্ক ছাড়ে খেজুরের দাম কমেছে, বিপাকে সিন্ডিকেট

দেশে বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রমজানেই প্রয়োজন হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন, কারণ ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। ফলে প্রতি বছর রমজান ঘিরে বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য দেখা যায়, যেখানে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করতেন এই খাত। তবে সরকার পরিবর্তন ও কাস্টমসের কিছু উদ্যোগে এবার সিন্ডিকেট তেমন সুবিধা করতে পারেনি। পাশাপাশি এনবিআর অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ও শুল্ক-কর কমানোয় খেজুরের দামও কমতে শুরু করেছে, যার সুফল পাচ্ছেন ভোক্তারা।

সূত্রে জানা যায়,বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে খেজুর আমদানি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটই নির্ধারণ করতো বাজার।তবে সরকার পরিবর্তনের পর চিত্র পাল্টেছে। একই সাথে সরকারও সব ধরনের খেজুরে অগ্রিম কর অব্যাহতি, কাস্টমস ডিউটি ও অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়েছে। এতে খেজুরের দাম বাজারে কেজি প্রতি সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা অবধি করেছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ভোগ্যপণ্য আমদানি শাখার এক রাজস্ব কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি বছর কয়েকজন আমদানিকারক সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। তারা একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ খেজুর আমদানি করে কাস্টম হাউসের কাছে শুল্ক কমানোর আবেদন জানাত। পণ্য খালাসের পর আবার শুল্ক বাড়ানোর আবেদন করত, যাতে অন্য আমদানিকারকরা সেই সুযোগ না পায়। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে তাদের কাছ থেকেই খেজুর কিনত, আর বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যেত তাদের হাতে। তবে এবার চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ সেই সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শুল্কায়নমূল্য পুনর্নির্ধারণের সময় সব আমদানিকারককে একসঙ্গে ডেকে সমান শর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ফলে কেউ এককভাবে সুবিধা নিতে পারবে না।

এদিকে গত বছর জাতিয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ও শুল্ক-কর বাড়ানোয় ভোগ্যপণ্যটির অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে বর্তমান সরকার পণ্যটির অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ও শুল্ক-কর কমিয়ে আনায় বাজারে খেজুরের দাম কমতে শুরু করেছে। যার সুফল পাচ্ছে ক্রেতারা। আমাদানিকরাকরা জানান এখন অবধি এলসির ৫০ শতাংশের মত ছাড় হয়েছে। বাকিগুলো বাজারে আসলে দাম আরও কমেবে।সংকট হবে না বাজারে।

আমদানিকারকরা জানান, বাজারে সব চেয়ে সস্তা খেজুর আরব দেশগুলো থেকে বস্তায় আমদানি করা হয়। এসব খেজুরের ক্রয়মূল্য সাধারণত প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭৪ টাকা। কিন্তু গত বছর ১০৮-১১০ টাকা (১ ডলার) অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ধরে শুল্কায়ন করে এনবিআর। একইভাবে গত বছর প্রতি কেজি নিম্নমানের খেজুরে ব্যবসায়ীদের শুল্ক পরিশোধ করতে হয়েছে ৬৪ টাকা ৪১ পয়সা। এরপর বাজারে পৌঁছতে প্রতি কেজি খেজুরে খরচ পড়ে ১৩৮-১৪০ টাকা। যা পাইকারি ও খুচরায় হাত বদলে ভোক্তাকে তা কিনতে হয়েছে ২০০ টাকায়।

তবে বর্তমান সরকার সব ধরনের খেজুরের দাম কমানোর জন্য আগের ৫ শতাংশ অগ্রিম কর বাদ দিয়েছে। কাস্টমস ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে এবং অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু কমিয়ে এনেছে। এতে পণ্যটির আমদানি মূল্য কমেছে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) জুলাই থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে ৪৯ হাজার ১৯৬ টন খেজুর আমদানি হয়েছে, যার আমদানি মূল্য ৯৩৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ সময়ে আমদানিকারকরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩৪৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেছে। এতে প্রতি কেজির গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৬০ টাকা। এই সময়ে ১৯১ জন আমদানিকারক খেজুর আমদানি করেছে।

অথচ গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) একই সময়ে হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আমদানি হয়েছিল মাত্র ২১ হাজার ৬৫৯ টন। তবে অর্থবছর শেষে মোট ৭৮ হাজার ৯৩৬ মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়, যার মূল্য ছিল এক হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আমদানিকারকরা এনবিআরকে ৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকা রাজস্ব পরিশোধ করেছিল। তখন মোট ২৯৩ জন আমদানিকারক খেজুর আমদানি করেছিল।

চট্টগ্রামের ফলমণ্ডির পাইকারি ব্যবসায়ী আবির জানান, বর্তমানে সৌদি আরবের মাবরুম খেজুরের পাঁচ কেজির কার্টন বিক্রি হচ্ছে ৫,৬০০ টাকায়, যার প্রতি কেজির মূল্য ১,১২০ টাকা। অথচ গত বছর এই খেজুরের একই পরিমাণ কার্টন ৬,৮০০-৭,২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, তখন প্রতি কেজির দাম ছিল প্রায় ১,৪৪০ টাকা। ফলে এবার প্রতি কেজিতে ৪০০ টাকা কমেছে।

সৌদি আরবের আমদানি করা আজওয়া খেজুর গত বছর মানভেদে প্রতি কেজি ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার তা ৬৪০-৮০০ টাকায় নেমে এসেছে। মিসর থেকে আসা মেডজুল খেজুর এবার ৯২০-৯৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ১,২০০-১,৪০০ টাকা—এতে প্রতি কেজিতে ৪৪৫ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

এছাড়া, ইরাকের জায়েদি খেজুরের দাম কেজিতে ১৭০ টাকা কমে ৩৫০-৩৭০ টাকা হয়েছে, নাগাল খেজুর ১৬০ টাকা কমে ৫৬০-৫৭০ টাকা, দাব্বাস খেজুর ১৬০ টাকা কমে ৭০০ টাকা এবং তিউনিসিয়ার ছররা খেজুর ১৪০ টাকা কমে ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।সবচেয়ে কম দামি খেজুর, যা বস্তায় আমদানি হয় এবং “বস্তা (নরম) খেজুর” নামে পরিচিত, গত বছর প্রতি কেজি ১৫৫-১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এবার কেজিতে ৩৫ টাকা কমে তা ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) তথ্যমতে, দেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা ৬০ থেকে ৯০ হাজার টন। শুধু রমজান মাসে ৪০ হাজার টন খেজুর প্রয়োজন হয়। খেজুর আমদানির তথ্য অনুযায়ী এবারের রমজানে সংকট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফআইএ) অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ৬০ থেকে ৯০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা থাকে, যার মধ্যে শুধু রমজান মাসেই প্রয়োজন হয় ৪০ হাজার টন। আমদানির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবারের রমজানে খেজুরের কোনো সংকট হওয়ার আশঙ্কা নেই।

**সিন্ডিকেট ভাঙায় কমেছে খেজুরের দাম

**খেজুর আমদানিতে শুল্ক-অগ্রিম কর কমলো

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!