শুল্কায়ন হয়নি, কিভাবে চললো ৩০০ কিলোমিটার?

বার্তা প্রতিবেদক: শুল্কায়ন ছাড়াই খালাস হয় বিশ্বখ্যাত রোলস রয়েস। কাস্টমসের অনুমতি ছাড়া সেই গাড়ি চট্টগ্রাম থেকে লুকিয়ে নেয়া ঢাকার বারিধারার বাড়িতে। ২৭ কোটি টাকার এই গাড়িতে অনিয়ম এখানেই শেষ হয়নি। গ্যারেজে লুকিয়ে রাখা এই গাড়িতে লাগানো হয় রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করা স্টিকার। সেই স্টিকার লাগানো রোলস রয়েস চালানো হয়েছে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। ইপিজেড ও কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে গাড়িটি ইপিজেড থেকে বের হলো-এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর সঙ্গে ইপিজেড ও কাস্টমসের কেউ জড়িত আছে কিনা-তা খতিয়ে দেখছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

৬ জুলাই রাজধানীর বারিধারার একটি বাড়ি থেকে একটি রোলস রয়েস জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গাড়িটি চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ (সিইপিজেড) এলাকার জেড অ্যান্ড জেড ইন্টিমেটস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি করা হয়েছে। জেড অ্যান্ড জেড ইন্টিমেটস লিমিটেড দেশের পোশাক খাতের স্বনামধন্য অনন্ত গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। যার ব্যবস্থাপনা পরিচালখ শরীফ জহির। যিনি বিজিএমইএ এর সাবেক পরিচালক। তিনি শুল্কমুক্ত সুবিধার ঘোষণা দিয়ে গাড়িটি আমদানি করেছেন। যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা বিলাসবহুল গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যাখ্যা দিয়ে আমদানি করার অভিযোগ উঠেছে তরুণ এই উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে। শুল্ককরসহ গাড়ির মূল্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা।

অপরদিকে, বন্দর থেকে গাড়িটি কীভাবে খালাস হলো, কাস্টমস ও ইপিজেড এর অনুমতি ছাড়া কীভাবে গাড়িটি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে, এর সঙ্গে কারা জড়িত-তা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ইপিজেড প্রতিষ্ঠানের সুবিধা নিয়ে অতীতে এ ধরনের বিলাবহুল গাড়ি আমদানি হয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখছে কাস্টমস গোয়েন্দা। একইসঙ্গে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানির তথ্য চেয়ে চট্টগ্রাম, কর্ণফুলী ও কুমিল্লা ইপিজেড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাড়িটি শুল্কায়ন ছাড়াই কাস্টমস কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে গাড়িটি চট্টগ্রাম ইপিজেডে জেড অ্যান্ড জেড কারখানায় নেওয়া হয়েছে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফলে কাস্টমসকে না জানিয়ে ইপিজেড থেকে বের করার সুযোগ নেই। এ ছাড়া গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে কায়িক পরীক্ষা ও শুল্কায়ন করে সরাসরি খালাস দেওয়ার কথা। ফলে গাড়িটি কাস্টমস থেকে কায়িক পরীক্ষা করা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান শুল্কায়নের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছে। বেপজার অনুমতি, এসআরও সুবিধা অনুযায়ী শুল্কায়নের অনুরোধ জানিয়েছেন। মালিকানা নিয়ে সমস্যা ছিলো। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে কিনা তার মতামত দিতে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আমদানিকারক কাস্টমসকে না জানিয়ে গাড়ি নিয়েছেন, ফলে আমদানিকারক অপরাধী। চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারের কাছে শরীফ জহির ভুল স্বীকার করেছেন। তবে এ ঘটনায় প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধের পাশাপাশি জালিয়াতির জন্য কাস্টমস আইনে তাকে জরিমানা করা হবে।

কাস্টমস গোয়েন্দার তথ্যমতে, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, চট্টগ্রাম ইপিজেডের জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড একটি প্রতিষ্ঠান ৬ হাজার ৭৫০ সিসির কলিনান এসইউভি মডেলের বিলাসবহুল রোলস রয়েস আমদানি করেছে। স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল ধরনের গাড়িটির আমদানির জন্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে এলসি খোলা হয়। ২৭ এপ্রিল বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে গাড়িটি যুক্তরাজ্যের ভারটেক্স অটো লিমিটেড থেকে গাড়িটি আমদানি করা হয়েছে। গাড়িটি শুল্কায়ন ছাড়াই খালাস নেয়া হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। আমদানি নথিতে গাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে দুই লাখ পাউন্ড।

সূত্রমতে, গাড়িটি বন্দর থেকে স্কট করে জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৪ জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ খালাসের ৭০ দিন পরও শুল্কায়ন কার্যক্রম শেষ করা হয়নি। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গোপনে জানতে পারেন, কাস্টমসকে অবহিত না করেই ১৭ মে রাতে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে অবৈধভাবে অপসারণ করা হয়েছে। বেআইনিভাবে অপসারণ করা গাড়িটির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। যাতে দেখা যায়, গাড়িটি চট্টগ্রাম থেকে বারিধারায় ওই কোম্পানির (জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহিরের বাসার গ্যারেজে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পরে কাস্টমস গোয়েন্দার একটি দল গাড়িটি গ্যারেজ থেকে জব্দ করেন।

অপরদিকে, গাড়ি নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানার পর শুল্কায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করে কাস্টমস গোয়েন্দা। ৩০ জুন আমদানি নথি চেয়ে ইপিজেড ডিভিশনের যুগ্ম কমিশনারকে চিঠি দেয়া হয়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নথি সরবরাহ না করায় ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার পুনরায় চিঠি দেয়া হয়। শুল্কায়ন ছাড়া গাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য কাস্টমস ও চট্টগ্রাম ইপিজেড কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হচ্ছে। বন্দর থেকে খালাসের ৭০ দিন পরও কাস্টমস কেন শুল্কায়নের ব্যবস্থা নেয়নি সেটিও খতিয়ে দেখছে কাস্টমস গোয়েন্দা। এ ঘটনায় বন্দরের কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও তদন্ত করা হবে।

কাস্টমস গোয়েন্দার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইপিজেডে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ২ হাজার সিসির গাড়ি আমদানি করতে পারেন। কিন্তু জেড অ্যান্ড জেড ৬ হাজার ৭৫০ সিসির গাড়ি আমদানি করেছে। যাতে শুল্ককর প্রায় ২৪ কোটি টাকা। আর কাস্টমস গাড়িটি বন্দর ইয়ার্ড থেকেই খালাস দিতে পারত। গাড়ি সরাসরি কারখানা নেওয়ার সুবিধার বিষয়টি সঠিক নয়। গাড়ি শুধু রাতের আঁধারে অবৈধভাবে অপসারণের অনিয়ম করেনি। গাড়ি ৩০০ কিলোমিটারের বেশি চালানো হয়েছে। শুল্কায়ন ছাড়া কীভাবে গাড়ি নিবন্ধনের আবেদন করা হয়েছে-তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আমদানি অনুমতি (ইমপোর্ট পারমিট) পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড হংকং এবং বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত। এটি পোশাক খাতের অনন্ত গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান (কৌশলগত বাণিজ্যিক অংশীদার বা এসবিইউ)। কোম্পানির তথ্যানুযায়ী, এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহীর। কোম্পানিতে তার শেয়ার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন শওকত আলী চৌধুরী। তার মালিকানা শেয়ার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তাসলিমা আম্বারিন ও আসিফ জহীর। কোম্পানিতে দুইজনের শেয়ার রয়েছে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ করে। আসিফ জহীর অনন্ত গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শ্রীলঙ্কার নাগরিক লিপেরুমা বাচ্চিজি কোম্পানির পার্টনার হিসেবে রয়েছেন, যার মালিকানা রয়েছে ১০ শতাংশ।

###

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!