পারভেজ হাসান, বিশেষ প্রতিনিধি: শুল্কমুক্ত সুবিধার কাপড় বন্দর থেকে খালাস হয়েছে ৯ মার্চ। সেই কাপড়ের গন্তব্য ছিল নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেড। কিন্তু বন্দর থেকে খালাস করে সেই কাপড় নেয়া হয়েছে চট্টগ্রামের একটি গুদামে। আমদানি করা সেই ৬৯১ রোল কাপড় গুদাম থেকে তোলা হয় তিনটি কাভার্ড ভ্যানে। উদ্দেশ্য ছিল অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করা। তবে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম কাভার্ড ভ্যানসহ সেই কাপড় আটক করেন। বন্ড সুবিধায় এ কাপড় আমদানি করেছে আদমজী ইপিজেডের ইউনিভার্সেল মেনসওয়্যার লিমিটেড। পোশাক খাতের অনন্ত গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিস জারি করেছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
নোটিসে বলা হয়, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামালের অবৈধ অপসারণ রোধকল্পে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ১৪ মার্চ একটি বিশেষ গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পারে, একটি বন্ডেড প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড় অবৈধ অপসারণের উদ্দেশ্যে আগ্রাবাদ রশিদ বিল্ডিং এলাকার একটি নন-বন্ডেড গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রির জন্য পরিবহনে করে নেয়া হবে। এ তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন বন্ড কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে কর্মকর্তারা দেখতে পান, আমদানি করা সেই কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে তিনটি কাভার্ড ভ্যানে (চট্ট মেট্রো-ট-১১-৩৯০৪, চট্ট মেট্রো-ট-১১-৪৪৭৭ ও চট্ট মেট্রো-ট-১১-৪৯৬৯) বোঝাই করা হচ্ছে। সেখানে উপস্থিত গুদাম ও গাড়ির লোকজন দুটি বিল অব এন্ট্রি ছাড়া কিছুই দেখাতে পারেননি।
আরও বলা হয়, দুটি বিল অব এন্ট্রি (বিল অব এন্ট্রি নং সি-৬৮৫৭৫, তারিখ ০৭.০৩.২২ এবং বিল অব এন্ট্রি সি-৬৮৯১০, তারিখ-০৭.০৩.২১) অনুযায়ী, কাপড়গুলো শুল্কায়ন করা হয়েছে ৭ মার্চ। খালাস হয়েছে ৯ মার্চ। কাপড়গুলো এফসিএল (ফুল কনটেইনার লোড) ভিত্তিক বন্ড সুবিধার আওতায় শূন্য শুল্ক হারে বন্দর হতে খালাস নেয়া হয়। আমদানি করা এই কাপড়ের এক্সিট পয়েন্ট উল্লেখ ছিল আদমজী ইপিজেড। বিল অব এন্ট্রি অনুযায়ী, কাপড়গুলো স্থানান্তরের পদ্ধতি স্পষ্ট উল্লেখ ছিল সি ওয়াই টু সি ওয়াই (কনটেইনার ইয়ার্ড টু কনটেইনার ইয়ার্ড)। ফলে কনটেইনারগুলো সরাসরি প্রতিষ্ঠানের বন্ডেড ওয়্যারহাউসে নেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে অপসারণের উদ্দেশ্যে বন্ড সুবিধার এসব কাপড় চট্টগ্রামের ওই নন-বন্ডেড গুদামে মজুত করে রাখে। খোলাবাজারে বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে প্রতিষ্ঠান। প্রিভেন্টিভ টিম ঘটনাস্থল থেকে মোট ৬৯১ রোল কাপড় আটক করেন, যার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর এক কোটি ৬৪ লাখ ৫ হাজার ২৭২ টাকা। চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট ২০ মার্চ ইউনিভার্সেল মেনসওয়্যার লিমিটেডের বিরুদ্ধে একটি আটক মামলা করে। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২২ মার্চ ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। চিঠি অনুযায়ী ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে ২৯ মার্চ দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউনিভার্সেল মেনসওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি আমার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমরা রেগুলার এক্সপোর্ট করি। ডকুমেন্ট দেখানোর পর তিনি বলেন, আমরা যে চিঠি পেয়েছি, তাতে বলা হয়েছে পণ্যগুলো শিপমেন্ট করে তাদের জানানোর জন্য। পণ্য আটক বিষয়ে বলেন, পণ্য আটক নয়, আর্জেন্ট রিলিজ করে আমরা পণ্য নিয়ে এসেছি। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্ড কর্তৃক পণ্য আটক ও ঢাকা বন্ড কারণ দর্শানোর নোটিস জারির বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামে আটক করা সেই কাপড় স্কটিং করে বন্ডারের (ইউনিভার্সেল মেনসওয়্যার লি.) গুদামে গুদামজাত নিশ্চিত করে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে একটি প্রতিবেদন দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ৩১ মার্চ ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে আদমজী ইপিজেডে কর্মরত সহকারী কমিশনারকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, ইউনিভার্সেল মেনসওয়্যার লিমিটেডের আমদানি করা পণ্য চালান আদমজী ইপিজেডের কাস্টমস অফিসে কর্মরত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মংসাচিং মারমার তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম হতে আদমজী ইপিজেডে স্কটিং করে বন্ডারের গুদামে গুদামজাত নিশ্চিত করে একটি প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্রমতে, চট্টগ্রাম থেকে কাপড়গুলো স্কটিং করে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানের বন্ড গুদামে আনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে কারণ দর্শানো নোটিসের জবাব দিয়েছে। এ বিষয়ে বন্ড কমিশনারেট আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান জবাব দিয়েছে। আর পণ্যগুলো আমাদের তত্ত্বাবধানে গুদামজাত করতে স্কটিং করে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। যাতে জব্দ পণ্য আবার বেহাত না হয়। ইতোমধ্যে স্কটিং করে চট্টগ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠানের বন্ড গুদামে আনা হয়েছে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের তথ্য যে, দেশের স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধার কাপড় খালাস করে আগ্রাবাদ এলাকায় আলাউদ্দিন নামে এক ব্যক্তির গোডাউনে লুকিয়ে রেখেছে। শুল্কমুক্ত সুবিধার এসব কাপড় নেয়ার কথা ছিল আদমজী ইপিজেডে। খোলাবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে এসব কাপড় এই গুদামে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ১৭ মার্চ কাপড়গুলো তিনটি কাভার্ড ভ্যানে তোলা হচ্ছে, এমন তথ্য পেয়ে বন্ড কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে তিনটি কাভার্ড ভ্যান ভর্তি কাপড় আটক করা হয়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্ড সুবিধার এই কাপড় কাস্টমসে শুল্কায়ন হয়েছে ৭ মার্চ। আর বন্দর থেকে খালাস হয়েছে ৯ মার্চ। আমরা আটক করেছি ১৭ মার্চ। ৮ দিন এই কাপড় এই গুদামে ছিল। অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যেই এ গুদামে রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অনন্ত গ্রুপ ও রোমানিয়ার টাইম ট্রেডিং এসআরএল যৌথভাবে ইউনিভার্সেল মেনসওয়্যার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে। এতে পুরুষদের স্যুট, জ্যাকেট, কোট ও ট্রাউজার উৎপাদন করা হয়।