** ২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে চুক্তিতে এনবিআরের অনুমতি ছাড়াই শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হয়
** বিদ্যুৎ আমদানির ওপর ৩১.০৭% শুল্ক-কর রয়েছে, যা পরিশোধ ছাড়াই দেয়া হচ্ছে আদানির বিল
** অনুমতি ছাড়া কীভাবে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে—জানতে চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে এনবিআর, তবে উত্তর দিচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ
** গত মার্চ পর্যন্ত আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হতো ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা পায়নি এনবিআর
গত বছর এপ্রিল থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ৩১ শতাংশের বেশি শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। তবে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক-কর দেয়া হচ্ছে না। ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে অবৈধভাবে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয় পিডিবি। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ২০১৪ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে ২০২২ সালে আদানির বিদ্যুতের ক্ষেত্রে শুল্ক-কর অব্যাহতি চায় পিডিবি। পরবর্তী সময়ে এনবিআরের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এনবিআরের অনুমতি ছাড়া আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কীভাবে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হলো—তার ব্যাখ্যা চেয়ে একাধিকবার বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। তবে এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও এনবিআরের চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধান করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ ও এনবিআরের মধ্যে আদান-প্রদানকৃত চিঠির কয়েকটির কপি হাতে আসে শেয়ার বিজের। এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর অব্যাহতির বিষয়টি জানিয়ে ২০২২ সালের ৮ জুন প্রথম চিঠি দেয় আদানি। এতে পিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর অব্যাহতি চাওয়া হয়। পাশাপাশি আয়কর অব্যাহতি দেয়ার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ করে আদানি। আদানির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে চিঠি দেয় পিডিবি। এতে বলা হয়, বিল্ট ওন অপারেট (বিওও) ভিত্তিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড (এপিজেএল) কর্তৃক নির্মাণাধীন ২x৮০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বাংলাদেশ ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি ও পিডিবির মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) এবং আদানি, বাংলাদেশ সরকার ও পিজিসিবির মধ্যে সম্পাদিত বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) স্বাক্ষরিত হয়। আইএ চুক্তির ১২.১ ধারায় আদানির বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতির কথা বলা হয়েছে। এ অব্যাহতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ বা আদেশ প্রদানের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার পালন করবে।
চিঠিতে পিডিবি আরও জানায়, এর আগে ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড (এনভিভিএন) থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) মওকুফ করে এনবিআর। এনবিআরের উক্ত অব্যাহতির ভিত্তিতে ভারতের পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেড, সেম্পকর্প ইন্ডিয়া ও এনভিভিএনের সঙ্গে পৃথক পিপিএর আওতায় আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতির মাধ্যমে আরও ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।
আদানি পাওয়ারের উক্ত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত আইএ অনুযায়ী আমদানি পর্যায়ে যাবতীয় শুল্ক-কর থেকে অব্যাহতি পাবে কোম্পানিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ আমদানি পর্যায়ের যাবতীয় শুল্ক মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা না করলে চুক্তি অনুযায়ী আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট পিডিবি তথা বাংলাদেশ সরকারের ওপর বর্তাবে। তাই আলোচ্য বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় স্বার্থে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে এনভিভিএনকে প্রদানকৃত অব্যাহতির অনুরূপ আদানি পাওয়ারের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ আমদানিতে যাবতীয় শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট অব্যাহতি প্রদানে এনবিআরকে অনুরোধ করতে বলা হয়।
পিডিবির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট এনবিআরকে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত আইএ’র ১২.১ অনুযায়ী আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ আমদানি পর্যায়ে যাবতীয় শুল্ক-কর (শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট) অব্যাহতি প্রদানে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের চিঠির উত্তরে ২০২৩ সালের ২ মার্চ পাল্টা চিঠি দেয় এনবিআর। এতে বলা হয়, ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মাণাধীন ১৪৯৬ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিতব্য বিদ্যুতের ওপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-করাদি মওকুফের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে চুক্তিতে উল্লিখিত অব্যাহতি প্রদানের বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আগে এনবিআরের কোনোরূপ মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা, তা দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। এনবিআরের মতামত গ্রহণ করা হলে তার একটি প্রতিলিপিও পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়।
যদিও এ চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ। পরে একই বছর ২২ মার্চ ও ১৩ এপ্রিল পুনরায় বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বরাবর একই চিঠি দেয় এনবিআর। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার কোনো উত্তর দেয়নি।
এ বিষয়ে জানতে গতকাল বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তিটি ২০১৬ বা ২০১৭ সালে করা। অনেক পুরোনো বিষয় তাই বিষয়টি স্পষ্ট জানা নেই। গত বছর এনবিআর চিঠি দিয়েছে—উল্লেখ করলেও তিনি বলেন, এটা পিডিবি ভালো বলতে পারবে। পরবর্তী সময়ে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনবিআরের অনুমতি ছাড়াই আদানির সঙ্গে চুক্তিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। তবে প্রকৃতপক্ষে এটি ২০১৭ সালে চুক্তির সময় পিডিবির নিয়ন্ত্রণেও ছিল না। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চুক্তিটি করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। একটি সূত্র বলছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় আদানি পাওয়ার লিমিটেডের ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ওপর শুল্ককর মওকুফের জন্য চিঠি দেয়া হয়। চিঠির সঙ্গে চুক্তির কপিও দেয়া হয়েছে। চুক্তির সেকশন ১২.১-তে শুল্ককর অব্যাহতির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ এনবিআরকে না জানিয়ে চুক্তিতে শুল্ককর অব্যাহতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অব্যাহতি প্রদানের বিষয়ে চুক্তির আগে এনবিআরের মতামত নেয়া হয়েছে কি না—বিষয়টি জানাতে এনবিআর থেকে বারবার বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো জবাব দেয়া হয়নি। ফলে অব্যাহতির বিষয়ে কর্মকর্তারা কিছুই জানেন না বলে একাধিক নিশ্চিত করেছে।
এদিকে আদানিকে শুল্ক-কর ছাড় দেয়ার জন্য পিডিবি ২০১৪ সালের এনবিআরের যে নির্দেশনার কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছে, সে সংশ্লিষ্ট এসআরওটি খুঁজে বের করে শেয়ার বিজ। এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক প্রকল্প অব্যাহতি) নভেরা মোয়াজ্জেম চৌধুরীর সই করা অব্যাহতির চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি চুক্তি সই হয়। সে অনুযায়ী পিডিবি ভারতীয় এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেডের কাছ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে। আমদানি করা এ বিদ্যুতের ওপর ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও ৪ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাটসহ মোট ৩১ দশমিক ০৭ শতাংশ শুল্ককর তিনটি শর্ত সাপেক্ষে মওকুফ করা হলো।
শর্তের মধ্যে রয়েছে—আমদানি করা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের আগে সংশ্লিষ্ট শুল্ক স্টেশনে শুল্ক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। অর্থাৎ আমদানি করা এই বিদ্যুতের বিল অব এন্ট্রি দাখিলসহ শুল্ককর-সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। বিদ্যুতের প্রতিটি বিল (ইনভয়েস) পরিচালক পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা সত্যায়িত করবেন এবং শুল্কায়নকালে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ বিলের মূল কপি ও তিন সেট ফটোকপি দাখিল করতে হবে।
যদিও আদানির বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই অনুসরণ করছে না পিডিবি। এমনকি কোন রুট দিয়ে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছে, তা এনবিআরকে জানানোও হয়নি। এ বিষয়ে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট শুল্ক স্টেশনে যোগাযোগ করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, আদানির বিদ্যুৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বগুড়া দিয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।
এদিকে আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারতের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আয় হয়েছে সাত হাজার ৩৭০ কোটি রুপি বা প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে এক হাজার ৪৬৮ কোটি রুপি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দুই হাজার ৩৪ কোটি রুপি, তৃতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এক হাজার ৮২৪ কোটি রুপি ও চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দুই হাজার ১৪৪ কোটি রুপি।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ওপর ৩১ দশমিক ০৭ শতাংশ হারে শুল্ক-কর প্রদান করলে এক বছরে এনবিআরের প্রায় তিন হাজার ২৩ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হতো। তবে অবৈধভাবে অব্যাহতির ফলে এনবিআর এ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।