শিক্ষার্থীদের ১৮ কোটি টাকা নিয়ে উধাও বিএসবির বাশার

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে রাজধানীর ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’ নামে একটি শিক্ষা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শত শত শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। চটকদার বিজ্ঞাপন, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অংশীদারিত্বের দাবি, আর নানা ‘সাফল্যের গল্প’ দেখিয়ে তারা গড়ে তোলে বিশ্বাসের একটি জাল, যার আড়ালে চলত ধাপে ধাপে প্রতারণা। এই প্রতারণার মূল হোতা প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার, যিনি বর্তমানে সপরিবারে পলাতক।

প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’-এর কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি ২৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে সিআইডি। ৪ মে ডিএমপির গুলশান থানায় অর্থ পাচারের এই মামলা করা হয়। সিআইডি জানায়, গত ডিসেম্বরেই তদন্তে বাশারের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে।

এছাড়া, আরও প্রায় ৭০০ ভুক্তভোগীর অভিযোগ জমা পড়েছে সিআইডির কাছে, যেগুলোর যাচাই-বাছাই চলছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ৮৫০ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছ থেকে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক উচ্চশিক্ষা, বৃত্তিসহ দেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানোর বিজ্ঞাপন দিত। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে সেখানে যেত। সবার কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা নিত। এরপর মাসের পর মাস ঘোরাত। বিদেশও পাঠাতে পারত না, টাকাও ফেরত দিত না। এ রকম প্রায় সাড়ে ৮০০ শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভাবকেরা সিআইডির কাছে অভিযোগ করেন। ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪১ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে অভিযোগের সত্যতা পায় সিআইডি। তাঁদের কাছ থেকে ১৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বাশার ও তাঁর প্রতিষ্ঠান। তবে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই। সব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এমনকি তাঁকেও দেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, খায়রুল বাশার ও তাঁর ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ছয় লাখ থেকে শুরু করে ৩০ লাখ টাকার বেশি অর্থ আদায় করেছেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত ৭৮ জন ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগকারীদের কেউ কেউ জানান, বিপুল পরিমাণ টাকা দেওয়ার পরও তাঁরা কোনো ভিসা পাননি, আবার কেউ কেউ ভিসা পেলেও শেষ পর্যন্ত বিদেশে যেতে পারেননি।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাহমুদুল করিম নামের এক ব্যক্তি দিয়েছেন ৯৪ লাখ, লিমা আক্তার ১৫ লাখ, তামান্না আক্তার ২২ লাখ, রাসেল আমান্ডা মণ্ডল ১৭ লাখ ২৭ হাজার, সাদমান সাইফ ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ও এম এ কাশেম ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা দেন। তাঁদের অভিযোগ, টাকা নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ঘোরাতে থাকে। কখনো বলে, ‘আপনার ফাইল হাইকমিশনে পাঠানো হয়েছে’, কখনো বলে ‘ভিসার প্রক্রিয়া চলছে’। একপর্যায়ে অনেকে বুঝতে পারেন, তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন। কেউ টাকা ফেরত চাইলে হুমকি দেওয়া হয়, এমনকি আইনি জটিলতায় ফেলার ভয়ও দেখানো হয়।

সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক লেনদেনের জন্য একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেছে। বেশির ভাগ চেক ইস্যু করা হয়েছে ব্যক্তিগত নামে, যাতে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা থেকে যায়। এরপর সেই অর্থ নানা পথে স্থানান্তর করা হয়েছে।

মামলায় ‘বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক’-এর কর্ণধার খায়রুল বাশার বাহার, তাঁর ছেলে আরশ ইবনে বাশার, স্ত্রী খন্দকার সেলিনা রওশন এবং অজ্ঞাতনামা আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে সিআইডি জানিয়েছে, আসামিরা কেউই বর্তমানে দেশে নেই। তাঁদের কাছে অন্য দেশের পাসপোর্ট থাকায় গোপনে দেশত্যাগ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানান, খায়রুল বাশারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ১৪১ জন ভুক্তভোগীর অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তবে আরও ৭০০ জনের অভিযোগ যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!