ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে (নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান) ব্যাপক লুটপাটের প্রভাব এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মাত্র তিন মাসে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। লাগামহীন লুটপাটের ফলে গড় হিসাবে এসব কোম্পানির মূলধন প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে, যা ক্রমাগত ঘাটতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ও মূলধন থেকে আয় না আসায় লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৫টি ফাইন্যান্স কোম্পানির মধ্যে ১১টিতে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে। ১৪টি কোম্পানিতে প্রয়োজনীয় মূলধন থাকলেও ১৬টিতে রয়েছে ঘাটতি। খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ও লুটপাটের কারণে আরও ৫টি কোম্পানির সম্পূর্ণ মূলধন ক্ষয়ে গেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন সংকট ও লোকসানের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর আয় হ্রাস পেয়েছে, বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বাড়তে থাকায় পুরো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানিগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মৌলিক মূলধন সংরক্ষণের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। এটি সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের বিষয় হিসাবে দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে সম্পদের গুণমান এবং লাভজনকতা বেশি মাত্রায় হ্রাসের কারণে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর কর্মক্ষমতা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
গত বছরের জুনে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ছিল ৫৭ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ৩১৮ কোটি টাকায়। ওই তিন মাসে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা বা প্রায় ২০ শতাংশ। তবে ২০২২ সালের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ কিছুটা কমেছে। কারণ, ওই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ আরও বেশি ছিল। ঋণের বিপরীতে প্রভিশন করায় এবং কিছু ঋণ আদায় হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ২০২২ সালের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সব মিলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ ছিল ৭০ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। গত জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকায়। গত সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। তিন মাসের হিসাবে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে ৪৩৫ কোটি টাকা বা ১ শতাংশের কম। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় মূলধন ছিল ৭ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা। গত মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে লুটপাটের ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি হতে থাকে। এর বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে না পারায় মূলধন ক্ষয় হয়ে যায়। এখন মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত জুনে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পদ থেকে কোনো আয় ছিল না। প্রতি ১০০ টাকায় লোকসান ছিল ৪০ পয়সা। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ১০০ টাকায় লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ২ টাকা ০২ পয়সায়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে লোকসান আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ০২ পয়সায়। এসব কোম্পানির প্রধান আয় হয় সম্পদ বা ঋণ বা বিনিয়োগ থেকে। এ খাতে সার্বিকভাবে আয় না হয়ে লোকসান হওয়ায় এ খাতে মন্দা প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে কয়েকটি ফাইন্যান্স কোম্পানি এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মূলধন বিনিয়োগ থেকে লোকসান ছিল ৭ টাকা ৮৫ পয়সা। গত বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ৬৭ পয়সা। এরপর থেকে গড় হিসাবে মূলধন ক্ষয় হয়ে গেছে। ফলে এখন আর মূলধন নেই। যে কারণে বিনিয়োগ থেকে এখন কোনো আয়ও নেই। অথচ মোট আয়ের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসত মূলধন বিনিয়োগ থেকে।২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ছিল ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। ওই সময়ে যা ছিল মোট ঋণের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। লুটপাটের ঋণ এখনো খেলাপি হচ্ছে। ফলে আগামী দিনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোয় সম্পদ আরও কমেছে। গত জুনে মোট সম্পদ ছিল ১ লাখ ৭১৭ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। তিন মাসে মোট সম্পদ কমেছে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে আলোচ্য সময়ে ক্যাশ ও লিকুইড অ্যাসেট ১৩ হাজার ৬২ কোটি টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।
ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর তারল্য সংকট ক্রমেই গভীর হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংক ও অন্যান্য ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ধার নেওয়ার স্থিতি ছিল ২৯ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে কমে ২৮ হাজার ৬২৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দুর্বল কিছু প্রতিষ্ঠান ঋণের টাকা ফেরত দিতে না পারায় অনেকেই তাদের নতুন করে ধার দিতে অনাগ্রহী, ফলে সামগ্রিকভাবে ধার নেওয়ার পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে, আমানত সামান্য বেড়ে ৪৭ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা থেকে ৪৯ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা হলেও মূলধন ঘাটতি উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত জুনে যেখানে ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ৯ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও অন্যান্য খাতের তারল্য ২৮ হাজার ৫২২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৯ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, মূলধন ঘাটতির কারণে সামগ্রিক তারল্য সংকট আরও প্রকট হয়েছে। জুনে মোট তারল্য ছিল ১ লাখ ৭১৭ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বরে কমে ৯৯ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।