২০১১ সালে আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতার আশীর্বাদে রেলের নির্মাণ খাতে আবির্ভূত হয় এক টেন্ডার ডন। মাত্র ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট কাজের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এখন পর্যন্ত রেল খাতের অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পেয়েছে এই অখ্যাত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। তবে এসব প্রকল্পের বড় অংশ লুটপাট হয়েছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, আর বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে গেছে দেশ-বিদেশের সুবিধাভোগীদের হাতে।
২০০৯ সালে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ছিল একেবারেই দুর্বল অবস্থায়। তখন তারা ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট প্রকল্প করত, তাও টেনেটুনে শেষ করতে হতো। ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করে চলত তাদের কার্যক্রম। তখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র ১৬.৭০ কোটি টাকার একটি রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, যার কাজের মানও ছিল নিম্নমানের।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মির্জা আজমের সহায়তায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার রাতারাতি বদলে যায়। দরপত্রে ১৫ নম্বরে থাকার পরও রাজনৈতিক সুপারিশের কারণে তারা ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা-আশুগঞ্জ রিনিউয়াল রেল প্রকল্পের কাজ পেয়ে যায়। প্রকল্পটি পেতেও তারা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। মাত্র ১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের সঙ্গে আরও দুটি চলমান প্রকল্প—৫০ ও ৯৬ কোটি টাকার—যোগ করে দরপত্রে অংশ নেয়। পরবর্তীতে মন্ত্রীর লিখিত সুপারিশে তারা ওই প্রকল্পের কাজ নিশ্চিত করে।নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রেলের নির্মাণ খাত নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
মূলত সেখান থেকেই ম্যাক্সের উত্থান শুরু। তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের নির্মাণ খাতের মাফিয়া খ্যাত দুই প্রভাবশালী নেতার সরাসরি হস্তক্ষেপে রেলের একের পর এক বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেতে থাকে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এই দুই নেতার প্রভাব খাটিয়ে রেলের সব প্রকল্প একাই গিলে খেয়েছে গ্রুপটি। শুধু রেল নয়, গত ১৫ বছরে উন্নয়ন খাতের অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। যা দেশের উন্নয়ন খাতের এক নজিরবিহীন ইতিহাস।
রেল খাতে ম্যাক্স গ্রুপের একচেটিয়া আধিপত্য
সরকার পরিবর্তনের পরও রেল খাতের সিন্ডিকেট ধরে রেখেছে ‘কালো বিড়াল’ খ্যাত ম্যাক্স গ্রুপ। চিনকি আস্তানা রেল প্রকল্পের পর প্রতিষ্ঠানটি কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ রেল প্রকল্পের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ পেয়েছে। বর্তমানে রেলের আরও দুটি বড় প্রকল্পেও কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান।প্রশ্ন ওঠে, পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই কীভাবে ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা রেল প্রকল্প, ২০১১ সালে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার লাকসাম-চিনকি আস্তানা প্রকল্প, ২০১৫ সালে ৬ হাজার কোটি টাকার আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ প্রকল্প এবং ২০১৬ সালে ১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার? মাত্র ৪ নম্বর গ্রেডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কীভাবে এসব বৃহৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিলো?কম অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও অল্প সময়ে যোগাযোগ খাতে মাফিয়া হয়ে ওঠার পেছনে কারা ছিল? কোন ক্ষমতার জোরে একচেটিয়া আধিপত্য চালিয়েছে ম্যাক্স? ১৬ কোটি টাকার কাজের যোগ্যতা থাকা একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পেলো—তা নিয়ে রেল খাতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তবে দরপত্রে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় কেউ ম্যাক্সের এই অস্বাভাবিক উত্থান নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ম্যাক্স গ্রুপের জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এর পেছনে থাকা শক্তিশালী গোষ্ঠীর ভূমিকা।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিকের ক্ষমতার যোগসূত্র ও রেল প্রকল্প দখল
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিক ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর নিজেকে বিগত সরকারের অন্যতম ডোনার হিসেবে পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষে কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের দেওয়া একাধিক বিবৃতিতেও তার স্বাক্ষর ছিল। সরকার পতনের পর দুর্নীতির দায়ে তিনি কারাভোগ করেছেন, এখনো তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলমান।আগের সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া ঠিকাদারদের একজন ছিলেন আলমগীর। রেলওয়ের পাশাপাশি সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। প্রতিষ্ঠানটির মালিক গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সম্পর্কের সুবাদে রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি।দরপত্রের যোগ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকলেও একের পর এক রেল প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ম্যাক্স লিমিটেড। প্রায় প্রতিযোগিতাহীনভাবে রেলের ৯০ শতাংশ প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রেল সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মূলত ৩০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়েই এই প্রকল্পের কাজ নিশ্চিত হতো।একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ বছরে রেলের ৭০ হাজার কোটি টাকার কাজ একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন মির্জা আজম। তিনি একটি বড় সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করতেন এবং মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে প্রকল্প বণ্টন করতেন। সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পগুলোর বড় অংশই নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে চলে যেত, যেখানে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিক আলমগীরের সরাসরি যোগসূত্র ছিল। তাই তিনি যেই প্রকল্পের কাজ চেয়েছেন, সেটিই পেয়েছেন।
যেভাবে প্রতারণা করেছে ম্যাক্স
ঠিকাদারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন আন্তর্জাতিক দরপত্রে জয়েন ভেঞ্চারের শর্ত মোতাবেক শুধু পার্টনার হিসেবে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে হলে ওই প্রকল্পের মোট মূল্যের অন্তত ২৬ শতাংশ মূল্যমানের কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। ম্যাক্সের ২ শতাংশ কাজ করারও অভিজ্ঞতা ছিল না। অনুসন্ধানেও একই তথ্য পাওয়া গেছে, কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী দরপত্র দাখিলের সময় ম্যাক্সের দেয়া অতীত অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে যে আইনগত পরিচয় ও কাজের কথা (লাকসাম-চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প) উল্লেখ করেছে, তা ছিল অস্পষ্ট ও জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ। এজন্য তারা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাতে তারা বিদেশি লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে মাক্স ওই কাজে অংশ নেয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। পরে ওই কাজের পুরো অভিজ্ঞতাকেই নিজের বলে দাবি করে চালিয়ে দিয়েছেন। যা রেল খাতের একটি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজটি মূল প্রকল্প দলিল ডিপিপি ও সংশোধিত প্রকল্প দলিলে আরডিপিপি মোতাবেক একটি একক কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যোগ্যতার মানদণ্ডে অতীত অভিজ্ঞতায় আর্থিক মূল্যমানের সীমারেখা বিবেচনায় ম্যাক্সকে ওই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য এই একক কাজকে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান ও মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। যেটা লট-১ ও লট-২ প্যাকেজ নামে পরিচিত। লট-২ প্যাকেজের কাজ ম্যাক্স লিমিটেড নিয়েছিল একটি চাইনিজ ঠিকাদারের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চার করে। বিষয়গুলো বোঝার জন্য এই লট-২ তে কাজের অতীত অভিজ্ঞতার কি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল সেটা দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন এই ব্যক্তি।
রিকোয়ারমেন্টে যা বলা হয়েছে
এই প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য ঠিকাদারদের অতীত অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে বিগত ১০ বছরের মধ্যে কমপক্ষে একটি কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার মূল্যমান ২৭০ মিলিয়ন ডলার। যা ২২৬৮ কোটি টাকা। এবং ট্র্যাক, ব্রিজ, ইমব্যাংকমেন্ট, স্টেশন বিল্ডিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। যদি প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট ভেঞ্চার করে তাহলে লিড পার্টনারের জন্য কাজের বৈশিষ্ট্য এবং মূল্যমানের ক্ষেত্রে পুরো অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এবং পার্টনারদের ক্ষেত্রেও ওইরূপ অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, তবে সেটা মূল্যমানের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ থাকলেই চলবে। অর্থাৎ ২২০৮ কোটি টাকার ২৫ শতাংশ যা ৫৬৭ কোটি টাকা। ম্যাক্স যে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছে, সে কাজে ম্যাক্সের আইনগত অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা কেমন ছিল? টিএসসি’র মতামতগুলো প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানের মাধ্যমে টেকনিক্যাল বিড ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট এড়িয়ে গিয়ে কীভাবে প্রভিয়াসলি কমপ্লাইড স্টাটার্সকে কমপ্লাইড করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট এডিবিতে গেলে পরবর্তীতে সেই জবাব হুবহু উল্লেখ করে প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান ম্যাক্সের জবাবকে বৈধতা দিয়ে সুপারিশসহ এডিবি’র কাছে পাঠিয়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ষোলকলা পূর্ণ করে। লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি সম্পাদিত হয় সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনের সঙ্গে। ম্যাক্স এখানে শুধু পার্টনার। কাজের সফল সমাপ্তিতে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্টকে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক অভিজ্ঞতার যে সনদ দেয়া হবে তাতে পার্টনার হিসেবে ম্যাক্সের নামও উল্লেখ থাকবে। ম্যাক্স এই অভিজ্ঞতার ক্রেডিনশিয়ালিটি পাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশন করার সময় ওই এসোসিয়েশনে তার অন্তর্ভুক্তির পার্সেন্ট হিসেবে।
পদে পদে ম্যাক্সের জালিয়াতি
২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশন চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র দেড় মাস পর, ওই জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনের তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ স্বাক্ষরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে একটি পত্র পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চারে যুক্ত দুটি চাইনিজ কোম্পানি—লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট এবং পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড—অনিবার্য কারণে চীন থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জনশক্তি, যন্ত্রপাতি এবং অর্থ দ্রুত আনতে পারবে না। সেজন্য তাদের স্থানীয় পার্টনার ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ১০০ শতাংশ কাজ একাই সম্পন্ন করবে।পরবর্তীতে, ডিসেম্বর ২০১১-তে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার আবারও একটি চিঠি দিয়ে দাবি করে, তাদের কাজ দ্রুত শুরু করা উচিত যাতে তারা পাঁচ মাস সময় (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল) কাজে লাগাতে পারে। তবে, চুক্তির শর্ত অনুসারে, অংশীদারদের মধ্যে কেউ যদি তাদের অংশের কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে অন্য অংশীদার তাদের বাকি কাজ শেষ করবে। এই শর্তে ম্যাক্স একাই ১০০ শতাংশ কাজ সম্পাদন করবে।এভাবে, একটি অনৈতিক ও অযৌক্তিক চুক্তির ভিত্তিতে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার তাদের কাজ শুরু করে এবং চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এক চুক্তিতে নিশ্চিত করে যে, ম্যাক্স তাদের নিজস্ব যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করে পুরো প্রকল্প শেষ করবে। এর পর, ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণের জন্যও ম্যাক্স দাবি করে।
ব্যাংক জানিয়েছে, তারা ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে লোন দিতে প্রস্তুত থাকবে, যদি বাংলাদেশ রেলওয়ে তাদের ১০০ শতাংশ কাজ করার অনুমতি দেয়। এরপর ম্যাক্স দাবি করে, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ রেলওয়ে তাদের নামে ১০০ শতাংশ প্রতিযোগিতা সনদ ইস্যু করবে। এটি ছিল ম্যাক্সের অন্যতম বড় চাওয়া এবং কৌশল। এর মাধ্যমে, ১৬.৭ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ১৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পে কাজ পাওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন উঠেছে, যখন ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাকসাম চিনকি আস্তানা প্রকল্পে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে কাজ পেয়েছিল, তখন কেন তারা এমন অবাস্তব প্রস্তাবনা উপস্থাপন করল, যেখানে চীনা কোম্পানিগুলো বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ম্যাক্সকে কাজ করার অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। এটি ছিল ম্যাক্সের পূর্ব পরিকল্পিত কৌশল, যা পুরোপুরি ক্রয় আইন, বিধি এবং চুক্তির শর্তবহির্ভূত ছিল।
মূলত, বাংলাদেশ রেলওয়ে কাজ পাওয়ার আগে লিড পার্টনার হিসেবে চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট এবং চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের যোগ্যতা যাচাই করে। কিন্তু ম্যাক্সের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাবনা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ম্যাক্সের অভিজ্ঞতার সনদ পেতে এই ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছিল, কারণ ১৬ কোটি টাকার অভিজ্ঞতা থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ দেওয়া সম্ভব ছিল না।
যেভাবে অভিজ্ঞতা সনদ নেয় ম্যাক্স
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার দাবি করেছে, চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট এবং চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জনশক্তি ও যন্ত্রপাতি দ্রুত দেশে আনতে পারবে না। তবে, প্রকল্পের প্রধান উপাদান সরবরাহ করেছে লিড পার্টনার চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট। প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকল্প পরিচালক নিজে এই সার্টিফিকেট নিশ্চিত করেছেন, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে লিড পার্টনার চীনা রেলওয়ে সময়মতো সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।তাহলে, ম্যাক্সের প্রস্তাবিত দাবি ছিল মিথ্যা। চীনা কোম্পানিগুলো নিজেই রেলপথ নির্মাণের মূল উপাদান সরবরাহ করেছিল, যার পরিমাণ ছিল ৭,০০০ টন। কিন্তু তারপরও, ম্যাক্স কেন তাদের অনুকূলে অভিজ্ঞতার সনদ চেয়েছিল, যখন প্রকৃতপক্ষে চীনা কোম্পানিরাই সরাসরি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল? এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে ম্যাক্স ১৮,০০০ কোটি টাকার কক্সবাজার প্রকল্পে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করতে পারে।লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে কাজ পেয়েছিল চীনা কোম্পানিরা, এবং তারা যৌথভাবে কাজ সম্পন্ন করেছিল। অভিজ্ঞতার সনদ তখন তিনটি কোম্পানির নামে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ম্যাক্সের নামে সনদ জারি করা হয়েছিল। চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকল্প পরিচালক তাদের অনুমোদনে এমন শব্দগত ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল, যা এই প্রতিবেদকের কাছে প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।
এ ছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে হওয়া ক্রয় চুক্তিতে কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, নাজনীনা আরা কেয়া, লিয়াকত আলী খান, মফিজুর রহমান ও আবুল কালাম চৌধুরী। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চেয়ে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কী অভিযোগ তা জানতে চান। বিস্তারিত জানানোর পরে লিখিত আকারে বক্তব্য দেবেন বলে জানান ম্যাক্সের মিডিয়া বিভাগের কর্মকর্তা ইব্রাহিম খালিদ পলাশ। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ম্যাক্সের কেউ আর সাড়া দেননি।
** সূত্র মানবজমিন