রেঞ্জ রোভার-বিএমডব্লিউতে ১৩ কোটি টাকা জরিমানা

অটো মিউজিয়ামের গাড়ি

** আমদানি করা রেঞ্জ রোভারে ৭ কোটি, বিএমডব্লিউ ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে
** ৫০০ শতাধিক হাইব্রিড গাড়ি বের হয়ে যাওয়ার পর কাস্টমস বলছে এসব নন-হাইব্রিড গাড়ি
** আমদানিকারকরা বলছে, এনবিআর হাইব্রিড গাড়ির কোনো ক্যাটাগরি ঠিক করে দেয়নি

কোনটি হাইব্রিড, কোনটি নন-হাইব্রিড বিষয়টি সুরহা এখনো হয়নি। এর মধ্যে অটো মিউজিয়ামের দুইটি বিলাসবহুল হাইব্রিড গাড়িকে ‘মিথ্যা ঘোষণা’ বলে জরিমানা করা হয়েছে। দুইটি গাড়িতে মোট ১৩ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে রেঞ্জ রোভারে সাত কোটি ও বিএমডব্লিউতে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। অটো মিউজিয়াম শো-রুমের মালিক রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা) এর সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন। অর্থাৎ হাইব্রিড ঘোষণা দিয়ে ব্র্যান্ডনিউ গাড়ি আমদানি করা হয়েছে।

মূলত মাইল্ড হাইব্রিড গাড়ি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এনবিআর মাইল্ড হাইব্রিড গাড়িকে নন-হাইব্রিড গাড়ি বলছে। ব্যবসায়ীরা এই গাড়িকে হাইব্রিড ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এনবিআর বলছে, ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসও) অনুযায়ী মাইল্ড নন হাইব্রিড গাড়ি হবে। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বিষয়ে এনবিআর কোনো আদেশ জারি করেনি। কোনো এইচএস কোডও নির্ধারণ করেনি। শুধু বলছে, মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বন্দরে একই ধরনের অন্তত ৩০-৩৫টি গাড়ি পড়ে রয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, আমদানিকারক অটো মিউজিয়াম ২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর গ্রেট ব্রিটেন থেকে একটি ‘ব্রান্ড নিউ রেঞ্জ রোভার পি৪০০ অটো বায়োগ্রাফি হাইব্রিড জিপ’ আমদানি করেছে। ২০২৩ মডেলের ২৯৯৬ সিসির গাড়িটি ছাড়ে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হলে খালাস স্থগিত করা হয়। পরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এআইআর ও এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) কর্মকর্তারা শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করেন। এতে দেখা গেছে, গাড়িটি ৬ সিলিন্ডারের। এটি পেট্টোল ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হবে। এর সঙ্গে ৪৮ভি মাইল্ড হাইব্রিড টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। এই মাইল্ড গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট বা স্টপ এর কাজ করে। এক্সিলারেশনের সময় গাড়ির ইঞ্জিনকে বুস্ট-আপ করে এবং গাড়ির ফুয়েল কনজামশনের কাজ করে। ফলে গাড়িটির শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী দেখা গেছে, গাড়িটি মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছে।

কাস্টমস বলছে, ডব্লিউসিও এর নির্দেশনা অনুযায়ী, এই গাড়িটি নন-হাইব্রিড। ফলে নন-হাইব্রিড হওয়ার সুযোগ নেই। এই গাড়িতে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এক কোটি ৫৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৯৫ টাকা। নন-হাইব্রিড বিবেচনায় এই গাড়িতে শুল্ককর ফাঁকির সম্ভাবনা ছিলো ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৬১ হাজার ৬১৬ টাকা। মিথ্যা ঘোষণা দেয়ায় অটো মিউজিয়ামকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার বিচারাদেশ দেয়। এতে আমদানিকারককে ৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কারণ হাইব্রিড গাড়ির আমদানি শুল্ক নন-হাইব্রিড গাড়ির আমদানি শুল্কের প্রায় অর্ধেক। যেমন— ২৯৯৬ সিসির হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক ২২১ শতাংশ। একই সিসির নন হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক ৪৩০ শতাংশ। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বলছে, ডব্লিউসও এর ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী, মাইল্ড হাইব্রিড গাড়িকে হাইব্রিড গাড়ি হিসেবে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই গাড়িগুলোও নন-হাইব্রিড গাড়ি হিসেবে শুল্কায়ন হবে।

অপরদিকে, একই আমদানিকারক ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘ব্রান্ড নিউ বিএমডব্লিউ এক্স-৭ এক্স-ড্রাইভ ৪০আই হাইব্রিড জিপ’ আমদানি করেছে। ২৯৯৮ সিসির গাড়িটি ২০২৩ মডেলের। একইভাবে এই গাড়িটির এআইআর ও সিআইসি খালাস স্থগিত করে। পরে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে মাইল্ড হাইব্রিড গাড়ির মতো এই গাড়িকে নন-হাইব্রিড উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়। এতে আমদানিকারক হাইব্রিড গাড়ি ঘোষণায় নন-হাইব্রিড গাড়ি আমদানি হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এই গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এক কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯২ টাকা। এতে শুল্ককর ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে দুই কোটি ৫৭ লাখ ৩ হাজার ১৭৭ টাকা। প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রক্রিয়া শেষে সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার বিচারাদেশ দেয়। এতে আমদানিকারককে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও ৩০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমদানিকারক লিখিত জবাবে সব ধরনের হাইব্রিড গাড়ির একই শুল্ক হারের কথা উল্লেখ করেছেন, যা সঠিক নয়। কারণ, শুল্ক হার নির্ভর করে মূলত গাড়ির সিসি ও গাড়িতে ইলেক্ট্রিক মোটরের কার্যক্রমের উপর। ডব্লিউসিও এর নির্দেশনা অনুযায়ী দুইটি গাড়ি-ই নন-হাইব্রিড। ফলে শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে। সেজন্য বিচারাদেশ দেয়া হয়েছে। চার বছর ধরে এসব গাড়ি হাইব্রিড হিসেবে খালাস হয়েছে। হঠাৎ কেন কোনো আদেশ জারি ছাড়াই এসব গাড়িকে নন-হাইব্রিড বলা হচ্ছে-এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর থেকে যে ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়, আমরা সে অনুযায়ী কাজ করি। বিষয়টি এনবিআর বলতে পারবে।

অপরদিকে, অটো মিউজিয়ামের মালিক ও বারভিডার সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, হাইব্রিড গাড়ি পরিবেশবান্ধব। চার বছর আগে এনবিআর বললো, যারা হাইব্রিড গাড়ি আমদানি করবে, তাদেরকে তেলের গাড়ির চেয়ে বেশি শুল্ক সুবিধা দেয়া হবে। সে থেকে আমিসহ ৩০-৩৫ জন আমদানিকারক বিভিন্ন মডেলের হাইব্রিড গাড়ি আমদানি করে আসছি। এই পর্যন্ত অন্তত ৫০০ গাড়ি আমদানি হয়েছে। তিনি বলেন, হাইব্রিড গাড়ি তিন ধরনের হয়। মাইল্ড, প্লাগিং ও ফুল। এনবিআর চার বছর ধরে বলেনি মাইল্ড গাড়ি হাইব্রিড নয়। হঠাৎ করে গত বছর থেকে কাস্টমস বলছে, মাইল্ড গাড়ি হাইব্রিড হিসেবে ছাড়া হবে না। আমার গাড়িও আটকে দেয়া হলো। বললো, ডব্লিউসিও নির্দেশনা আছে। আমরা বললাম, আমরা দেশের আইনকে শ্রদ্ধা করি। আপনারা (এনবিআর) কোনো এসআরও জারি করেন, এইচএস কোড দেন। তারা আজ পর্যন্ত তা দেয়নি। গায়ের জোরে বলছে, আমরা মিথ্যা ঘোষণা দিয়েছি। আমরা আদালতে গিয়েছি।

আদালত বলেছে, এনবিআর কোনো আদেশ জারি না করলে আগের আদেশ অনুযায়ী হাইব্রিড হিসেবে গাড়ি যাবে। কিন্তু কাস্টমস মানতেছে না। এটা তো তেলের গাড়ি হলে মিথ্যা ঘোষণা হতো। গাড়ি আনার আগে তারা বলেনি। আমদানির পর বলছে এটা নন হাইব্রিড গাড়ি। আমার মতো আরো আমদানিকারকের অন্তত ৩০-৩৫টি গাড়ি একই জটিলতায় বন্দরে পড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, কাস্টমসের হয়রানি টার্গেট হয়ে গেছে। এইচএস কোড এর সংখ্যা ভুল বা অন্য কিছু বলে ২০০ থেকে ৪০০ শতাংশ জরিমানা করে দেবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!