রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের দেনা শোধে অগ্রগতি

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ রাশিয়াকে পরিশোধের অচলাবস্থা অবশেষে কাটতে চলেছে। অসামরিক পারমাণবিক প্রকল্পের দেনা শোধে যুক্তরাষ্ট্রের ডিসেম্বর পর্যন্ত শিথিলতা কিংবা লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া—এই দুই পথ বিবেচনায় রয়েছে সরকার। এদিকে রাশিয়া কীভাবে অর্থ গ্রহণ করতে চায়, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থ পরিশোধ আটকে আছে। রাশিয়ার অর্থ গ্রহণের পরিকল্পনা জানার পর যুক্তরাষ্ট্রের অনাপত্তি পাওয়া গেলে দ্রুত সেই অর্থ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ। এর আগে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে অর্থ পরিশোধসহ নানা বিকল্প চেষ্টা করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. শাহ্‌রিয়ার কাদের ছিদ্দিকী জানিয়েছেন, রাশিয়ার দেনা পরিশোধে যুক্তরাষ্ট্র আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ পরিশোধ প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু করেছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে রাশিয়ার পাওনা পরিশোধ বন্ধ হয়ে যায়। তবে সম্প্রতি এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দেনা পরিশোধে শিথিলতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার সহায়তায় বাস্তবায়িত এ প্রকল্প শুরু হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগেই। এ কারণে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ রাশিয়া কোন মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করতে চায়, তা জানতে চেয়েছে। রাশিয়ার পরিকল্পনা জানার পর যুক্তরাষ্ট্রের অনাপত্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি লাইসেন্সিং পদ্ধতিতেও অর্থ শোধের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের গণ্ডির বাইরে বিকল্প উপায়ে অর্থ প্রদান সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার ‘এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট’ সোনালী ব্যাংকে কয়েকটি বৈদেশিক মুদ্রার (এফসি) অ্যাকাউন্ট খুলতে আগ্রহী। এ নিয়ে গত বুধবার প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তাদের প্রস্তাব, পাওনা অর্থ এটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করা হোক, সেখান থেকে তারা তা রাশিয়ায় নিয়ে যাবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় অর্থ স্থানান্তর সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। কারণ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সব ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্ট যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্র দেশের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম সুইফ্টও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অনুসরণ করে, ফলে এ পথে অর্থ পরিশোধ করা যাবে না।

রাশিয়ার অর্থায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট’-এর চুক্তি হয়। চুক্তির মোট অর্থের ৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা) দিচ্ছে রাশিয়া। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে স্থানীয় ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে। মূল ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালের মার্চে। তবে বর্তমান সরকার সময় বাড়িয়ে ২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড চেয়েছে, যদিও এ বিষয়ে রাশিয়ার সিদ্ধান্ত এখনও জানা যায়নি। এর মধ্যে ২০২৩ সাল থেকে ঋণের সুদ এবং প্রকল্প ঋণের বাইরে প্রাথমিক কাজে নেওয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য ব্যাংকের ‘স্ক্রো’ অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ১০৩ কোটি ১৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে গত অর্থবছরে জমা হয় ২২ কোটি ২৮ লাখ ডলার। তবে রাশিয়ার দাবির ভিত্তিতে স্থানীয় ঠিকাদারের বিল, সরবরাহকারীর পাওনা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ১৮ কোটি ডলার ইতোমধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে পরিশোধের অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি ডলার। এ প্রকল্পে সঞ্চালন লাইনসহ বিভিন্ন কাজে ভারত, সিঙ্গাপুর, তুরস্কসহ নানা দেশের নাগরিক যুক্ত আছেন, যাদের বৈদেশিক মুদ্রায় বিল পরিশোধ করতে হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর ২০২২ সালে রাশিয়া চিঠির মাধ্যমে তাদের সব ধরনের পরিশোধ স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছিল। এরপর আইএমএফের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ হিসাব খুলে দেশটির সব পাওনা আলাদা করে রেখেছে। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় রাশিয়া আর দেরি করতে চাচ্ছে না। তাদের চাহিদা অনুযায়ী, গত বছরের জুনে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নায় অ্যাকাউন্ট খুলে রাশিয়ার পাওনা পরিশোধের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্যের ঝুঁকির কারণে শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!