** ১৩ করবর্ষের রিটার্ন সার্কেল থেকে সরিয়ে নিজ চেম্বারে নিয়ে যান আইটিপি ওবায়দুল হক সরকার
** ১৩ করবর্ষের পুরাতন রিটার্ন নতুন করে তৈরি করা হয়, যাতে করযোগ্য আয় বাদ দিয়ে প্রায় ২৩৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা করমুক্ত আয় সংযোজন করা হয়েছে
** রিটার্ন জালিয়াতি ও করফাঁকির চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করদাতা এসএ পরিবহনের মালিক সালাহউদ্দিন আহমেদ ও আয়কর আইনজীবী ওবায়দুল হক সরকারের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে
** সালাউদ্দিনের আয়কর ফাইলে ৭৫ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি পাওয়া গেছে, ফাঁকির পরিমাণ হিসাব করছে সিআইসি
এসএ গ্রুপের কর্ণধার ও এসএ পরিবহনের মালিক সালাহ উদ্দিন আহমেদ। কর অঞ্চল-৫, সার্কেল-৯৩ এর করদাতা। এই করদাতার ১২ করবর্ষের অ্যাসেসমেন্ট শেষে বিপুল পরিমাণ কর নির্ধারণ করেছে উপকর কমিশনার। তিনি আপিল, ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্টে নিজের পক্ষে রায় পাননি। যার অর্থ হলো এই করদাতাকে বিপুল পরিমাণ এই কর দিতে হবে। বহু বছর ধরে নির্ধারিত সেই কর পরিশোধ করেন না। এই কর পরিশোধ না করতে তার আয়কর আইনজীবী ওবায়দুল হক সরকারকে দিয়ে ফন্দি আটলেন। সার্কেলের কর্মচারী ও সার্কেল কর্মকর্তাকে কোটি টাকা ঘুস কন্ট্রাক করলেন। যার মধ্যে ঘুসের ৩৮ লাখ টাকা পরিশোধও করেছেন। বিনিময়ে সার্কেল থেকে করদাতা সালাহ উদ্দিন আহমেদের ১২ করবর্ষের পুরাতন রিটার্ন এই আইনজীবীর চেম্বারে নিয়ে গেলেন।
আর এই ১২ করবর্ষের রিটার্ন নতুন করে তৈরি করলেন। তাতে করফাঁকি দিতে অন্তত ২৩৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকার করমুক্ত আয় সংযোজন করেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ঘুস গ্রহণ ও আয়করের স্পর্শকাতর নথি সরবরাহ করায় সহকারী কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সঙ্গে রিটার্ন জালিয়াতি ও রিটার্নে করমুক্ত আয়যুক্ত করায় করদাতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ এবং আয়কর আইনজীবী ওবায়দুল হক সরকারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। একইসঙ্গে সালাহ উদ্দিন আহমেদের আয়কর ফাইল খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর আয়কর আইনজীবী (আইটিপি) এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করদাতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত দুরন্ধর ব্যক্তি। তিনি বছরের পর বছরের প্রযোজ্য কর পরিশোধ করেন না। করফাঁকি দিতে সব সময় রিটার্নে ভুয়া, মিথ্যা তথ্য দেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা ও পথ দেখাতেন কর আইনজীবী ওবায়দুল হক সরকার। কোন কর্মকর্তা কথা না শুনলে তাকে নানান ধরনের হুমকি দেয়া হতো। শেষে একজন জুনিয়র অফিসারের (সহকারী কর কমিশনার) চাকরি খেয়ে দিয়েছেন। এই করদাতা ও আইনজীবীর বিরুদ্ধে এনবিআর কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সালাহ উদ্দিন আহমেদ ও ওবায়দুল হক সরকারের ব্যাংক হিসাব জব্দ (ফ্রিজ) করেছে সিআেইসি।
এনবিআর সূত্রমতে, তথ্য পাওয়ার পর সিআইসি কর্মকর্তারা যাচাই করেন। যাতে কর আইনজীবী ওবায়দুল হক সরকারের চেম্বারে ১২ করবর্ষের পুরাতন রিটার্নসহ অন্যান্য প্রমাণিত রয়েছে। পরে সিআইসি কর্মকর্তারা রিটার্ন ও অন্যান্য কর সংক্রান্ত কাগজপত্র দিয়ে দিতে ওবায়দুল হককে অনুরোধ করেন। তবে প্রথমে তিনি অস্বীকার করলেও পরে দিতে বাধ্য হন। কর্মকর্তারা তার চেম্বার থেকে করদাতা সালাহ উদ্দিন আহমেদের আয়কর সংক্রান্ত সকল নথি উদ্ধার করেন। এতে দেখা যায়, আইটিপি ওবায়দুল হক সরকার সালাহ উদ্দিন আহমেদের পুরাতন ১২ করবর্ষের রিটার্ন নতুন করে তৈরি করেছেন। তাতে তিনি প্রায় ২৩৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকার করমুক্ত আয় বা সম্পদ সংযোজন করেছেন। যদিও পুরাতন রিটার্নে সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিপুল পরিমাণ করযোগ্য সম্পদ ও করের পরিমাণ ছিলো। তবে সালাহ উদ্দিন আহমেদের পুরাতন ফাইলে প্রযোজ্য আয়করের পাশাপাশি ৭৫ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকিও উদ্ঘাটন করা রয়েছে। ওবায়দুল হক সালাহ উদ্দিন আহমেদের ১২ করবর্ষের রিটার্নসহ পুরো ফাইল তার চেম্বারে নিয়ে নতুন রিটার্ন তৈরি করে দিতে সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতু ও সার্কেলের কর্মচারীদের সঙ্গে এক কোটি টাকার চুক্তি করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে এনবিআর কর্মকর্তারা। মিতুর মোবাইল ফোনে কিছু প্রমাণ ও তার লিখিত স্বীকারোক্তিতে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঘুসের ৩৮ লাখ টাকা নিয়ে তিনি খরচ করে ফেলেছেন বলে কর্মকর্তাদের কাছে মিতু স্বীকার করেছেন। স্বীকারোক্তি ও মোবাইলে প্রমাণ পাওয়ায় ঘুস গ্রহণের অভিযোগে ১ সেপ্টেম্বর মিতুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কর অঞ্চল-৫, ঢাকার সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতু। তিনি এই কর অঞ্চলের সার্কেল-৯৩ এর করদাতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ থেকে ৩৮ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন। যার বিনিময়ে এই করদাতার মনোনীত প্রতিনিধিকে (আয়কর আইনজীবী বা আইটিপি) স্পর্শকাতর আয়কর নথির অধিকাংশ পূর্ববর্তী রেকর্ড সরবরাহ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে পুরোনো আয়কর রিটার্ন, অর্ডার শিট, কর নির্ধারণী আদেশ, আপীল ও ট্রাইব্যুনালের আদেশ এবং অন্যান্য ডকুমেন্টসসমূহ। সেজন্য এই সহকারী কর কমিশনারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি-১২ অনুযায়ী সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতুকে এনবিআরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপূর্বক চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তকালীন তিনি বিধি মোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।