২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হলেও এখনো পুরো অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয়নি। এই ঘটনায় মামলা হওয়ার পর সিআইডি তদন্ত শুরু করলেও ৯ বছরেও তা শেষ হয়নি। এটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ হলেও যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া—এই পাঁচ দেশ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য পায়নি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্তে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট পাঁচ দেশের সহযোগিতা জরুরি। তবে মামলাটি ভুল ধারায় করায় নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় এটি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এখতিয়ারভুক্ত। দুদক তদন্তের দায়িত্ব চাইলে সিআইডি এখনও তার জবাব দেয়নি। এ ছাড়া, চুরির ঘটনায় ৭৬ বিদেশি নাগরিকের সংশ্লিষ্টতার তথ্যও মিলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর পর্যন্ত ১ হাজার ৯২৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার হ্যাক করার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি হ্যাকার গ্রুপটি। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘটনার অন্তত ১৩ মাস আগে থেকে হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লেনদেনের কমিউনিকেশন সিস্টেমে ভাইরাস ঢোকানো হয়। এর পাঁচ মাস পর ওই বছরের মে মাসে ফিলিপাইনের ব্যাংকে পাঁচটি হিসাব নম্বর খোলা হয়। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে হ্যাক করে রিজার্ভের অর্থ সরানো হয়।
শুরুতে ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানসহ অনেকে জানলেও তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। এ ঘটনা যাতে কেউ জানতে না পারে, সে জন্য তিনি সবাইকে কঠোর নির্দেশনাও দেন। ঘটনাটি ধামাচাপার চেষ্টা চালানো হয়। শুরুর দিকে ফিলিপাইনের বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানালে হ্যাকারদের কাছে পৌঁছানোর আগে এ অর্থ জব্দ করা যেত। এই উদ্যাগ না নিয়ে ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইনের ব্যাংকে কয়েকটি ই-মেইল করে দায়িত্ব সারে। এতে কোনো কাজই হয়নি। হ্যাকিংয়ের আট দিনের মাথায় ফিলিপাইনের ব্যাংক থেকেও টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ৩৯ দিন পর মতিঝিল থানায় মামলা হয়, যেখানে চুরি, আইসিটি ও মানি লন্ডারিং ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হলেও হ্যাকিংয়ের সুনির্দিষ্ট ধারা উল্লেখ করা হয়নি। এতে জড়িতদের সুবিধা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম এলেও অভিযোগপত্র থেকে তা বাদ দেওয়ার চাপ ছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হ্যাকাররা ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ৩৬ মিনিট থেকে ৩টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমে অবস্থান করে। সিআইডি ১৬ মার্চ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র জব্দ করে। তদন্তের জন্য আট দেশে চিঠি পাঠানো হলেও শুধু জাপান, ভারত ও ফিলিপাইন উত্তর দিয়েছে। ফিলিপাইনের ৪২, শ্রীলঙ্কার ৮, চীনের ১৭, ভারতের ৮ ও জাপানের ১ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। মূল হ্যাকার ছিলেন উত্তর কোরিয়ান বংশোদ্ভূত চীনের নাগরিক পার্ক, যিনি চীনে বসে একটি কোম্পানি খুলে হ্যাকিং পরিচালনা করেন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩৪.৬১ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার হয়েছে। বাকি ৬৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন এখনও বেহাত। বাংলাদেশ ব্যাংক ফিলিপাইন ব্যাংকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করেছে। মামলায় জিততে পারলে বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।
জানা যায়, রিজার্ভ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় যে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে, সেখানে হ্যাকিংয়ের অনেক তথ্য গায়েবের বিষয় উঠে এসেছে। সেখানে ঘটনাক্রমে অমিল পাওয়া যায়।
আরেকটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি তদন্তে ১৪ কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য উঠে এসেছে। তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান নিষেধাজ্ঞার আগেই দেশ ছাড়েন। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের সাবেক পরিচালক আনিসউদ্দিন আহমেদ খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার দীপঙ্কর কুমার চৌধুরী, সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক এস এম রেজাউল করিম, সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা, মামলার বাদী জুবায়ের বিন হুদা, সাবেক উপপরিচালক (সুইফট অপারেটর) জি এম আব্দুল্লাহ সালেহীন, সহকারী পরিচালক শেখ রিয়াজ উদ্দিন ও একলাস উদ্দিন।