ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সরকারের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে দুর্বল সরকারি আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ, একীভূতকরণ বা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, কিছু প্রতিষ্ঠানের লোকসান সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নতুন আইন প্রণীত হতে পারে, যা অধ্যাদেশ আকারে জারি হবে।
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাই যেসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে রয়েছে এবং কোনোমতেই লাভজনক করা সম্ভব হবে না, সেগুলো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বন্ধ করার এখতিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে রেখে এই আইন করা হচ্ছে।
নতুন আইনের খসড়া, সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ (ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়) আইন, ২০২৫-এ বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগ সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের যথার্থতা পরীক্ষা করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কোনো সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে স্থানান্তর, একীভূতকরণ বা বিলুপ্তি করা যেতে পারে। অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে ১৩ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হবে, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাজ করবে। কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পদ্ধতি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে, তথ্য অধিকার আইনের বিধান মেনে প্রতিটি সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক লক্ষ্য, ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, লেনদেন বিবরণের বর্তমান অবস্থা, গ্রাহক সন্তুষ্টি সমীক্ষার ফলাফল, মামলাসংক্রান্ত তথ্য এবং মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। কোনো প্রতিষ্ঠান এসব তথ্য প্রকাশে ব্যর্থ হলে বা ভুল তথ্য দিলে ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকার। এতে আরও বলা হয়, সরকার চাইলে সরকারি মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে যে কোনো সময় এক বা একাধিক নিরপেক্ষ পরিচালক বা অন্য কোনো উপযুক্ত পদ নামে কর্মকর্তা নিয়োগ করতে পারবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আইনটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সব ব্যাংক, তেল-গ্যাস কোম্পানি, আর্থিক, অ-আর্থিক, বাণিজ্যিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ আইনের আওতাভুক্ত হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন কোম্পানি, করপোরেশন বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পৃথক আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তবে এসব প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ, বিলুপ্ত কিংবা একীভূত করতে পৃথক আইন নেই।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের অবস্থা
দেশে ১৩১টি আর্থিক এবং ৪৯টি অ-আর্থিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার জন। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান অব্যাহতভাবে লোকসান দিচ্ছে। জাতীয় বাজেটের নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে। গত অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৪৯টি অ-আর্থিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কাছে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের পাওনার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। মূলত শিল্প, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, বাণিজ্য, কৃষি এ নির্মাণ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এর আওতাভুক্ত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বাবদ নানা উপায়ে এসব ঋণ হিসেবে এ অর্থ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে না।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি), বাংলাদেশ বস্ত্রকল করপোরেশনের (বিটিএমসি), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি), বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি), বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) উল্লেখযোগ্য। সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ ধরনের ৩০টি সংস্থার কাছে ব্যাংকের পাওনা বা ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।
সমীক্ষার তথ্য বলছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে ৪৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে আটটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ঋণখেলাপি। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৮৪ কোটি টাকা। অনেক প্রতিষ্ঠানের দায় ও লোকসান উচ্চ পর্যায়ে। বেশির ভাগ উৎপাদনমূলক প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে বন্ধ থাকলেও, সরকার বেতন-ভাতা দিতে প্রতি বছর বাজেট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। যেমন– রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মোট সম্পদ ১৫ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এ সম্পদের প্রায় পুরোটাই জমির দাম হিসেবে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের দেনা তাদের মূলধনের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। চলতি অর্থবছর পাটকলগুলোর মোট লোকসানের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৪৭ কোটি টাকা।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন কোম্পানিগুলোর সম্পদের মূল্য ৭ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা, যার প্রায় পুরোটাই জমি। চলতি বাজেটে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট লোকসানের পরিমাণ ২৯০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বিসিআইসির অধীন কয়েকটি ইউরিয়া সার কারখানা ছাড়া বাকিগুলো বহু বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানার সম্পদের পরিমাণ ১৬ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ তাদের মূলধনের চেয়ে ১৩ গুণেরও বেশি। চলতি অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট লোকসান ১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা হবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
যৌক্তিকতার ভিত্তিতে কিছু সংস্থা বেসরকারীকরণের উদ্যোগ দীর্ঘদিনের। এ জন্য বেসরকারীকরণ কমিশনও গঠন করা হয়েছিল। এ ছাড়া কিছু দুর্বল ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে গুরুত্বহীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তবে শেষ পর্যন্ত এসব উদ্যোগ খুব বেশি আলোর মুখ দেখেনি।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, এর আগে দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে দেওয়ার জন্য বেসরকারীকরণ কমিশন করা হয়েছিল। কিন্তু খুব একটা কাজে আসেনি। তিনি যখন অর্থ সচিব ছিলেন, তখন হিসাব করে দেখেছেন, প্রতি কেজি চিনি আমদানির খরচ ছিল ২০ টাকা, অথচ সরকারি সুগার মিলে উৎপাদন খরচ ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এসব লোকসানি কারখানা বন্ধ করতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখেছিলেন; কিন্তু সরকার সেগুলো বন্ধ করেনি। এ খাতে সরকারকে অনেক বেশি ভর্তুকি দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, বাজেট ব্যবস্থাপনার স্বার্থে পরিপূর্ণভাবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অত্যাবশ্যক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া কিংবা বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। তবে শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে শুধু অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কমিটির সুপারিশে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে হবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। এ আইন চূড়ান্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু কাজ করে যেতে পারলে তা হবে অন্যতম বড় সংস্কার।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও দক্ষতার অভাবে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত লোকসান দিয়ে আসছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয় না। দেশ ও জাতির স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ কিংবা বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেটাই প্রশ্ন। শুরু করতে পারলে ভালো এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ কাজট করতে হবে। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য, আগের রাজনৈতিক সরকারগুলো এ ধরনের সংস্কারে আগ্রহী ছিল না।
২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারীকরণ কমিশন গঠন করেছিল। ২০১৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে, আর কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ করা হবে না। এরপর প্রাইভেটাইজেশন কমিশন বিলুপ্ত করে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের সঙ্গে একীভূত করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) প্রতিষ্ঠা করা হয় আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। তারপর থেকে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ করা হয়নি। বিশেষ আইন পাস করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়।