রায় পক্ষে গেলেও আদায় হয়নি ৩৭১ কোটি টাকা

খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড

** উচ্চ আদালতে ছয়বছরে সাতবার স্থগিতাদেশ দিয়েছে, পরে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলেও জানে না কমিশনারেট
** কাস্টমস আপিলাত ট্রাইব্যুনাল আপিল খারিজ করলেও জানে না বন্ড কমিশনারেট, শুল্ককর আদায়ে নেয়নি উদ্যোগ
** বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৮০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড ২০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে

বন্ড সুবিধায় আমদানি হয়েছে কাঁচামাল। সেই কাঁচামাল শুল্ককর পরিশোধ করা হয়নি। অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। আবার কিছু কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু স্বপক্ষে রপ্তানির প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তিন অর্থবছরে কেবল বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামালে শুল্ককর পরিশোধ করা হয়নি প্রায় ৩৭১ কোটি টাকা (সুদসহ ৪৫০ কোটি টাকা হতে পারে)। বন্ড সুবিধার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। শুল্ককর ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠানটি হলো পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ও খুলনার লকপুর গ্রুপের বহুল আলোচিত খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। ২০১৬ সালে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট (বর্তমানে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণ) এর কমিশনার এই আদেশ দেন।

প্রতিষ্ঠান সংক্ষুদ্ধ হয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করে। আপিল করতে হলে কাস্টমস আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে ফাঁকি দেয়া শুল্ককরের ২ শতাংশ নগদ সরকারি কোষাগারে জমা ও ২ শতাংশ ব্যাংক গ্যারান্ট্রির চেক দিতে হবে। আপিলাত ট্রাইব্যুনাল নগদ ও ব্যাংক গ্যারান্ট্রির চেক জমা দেয়ার আদেশ দিলে প্রতিষ্ঠান সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে। উচ্চ আদালত সেই আদেশের উপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। সেই স্থগিতাদেশ ছয়বার ও পুনরায় এক বছর বাড়ে। অর্থাৎ স্থগিতাদেশে চলে যায় ছয় বছর। শেষে উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ খারিজ করে ট্রাইব্যুনালের আদেশ মানতে নির্দেশ দেয়। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। স্থগিতাদেশ ছয় বছর ঘুরেছে, উচ্চ আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে।

কিন্তু বন্ড কমিশনারেট উচ্চ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল-কোথাও থেকে এই আদেশের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে খোঁজ রাখেনি। সরকারের এই বিপুল রাজস্ব আদায়ে উদ্যোগও নেয়া হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, বন্ডের এক শ্রেণির কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠান সুবিধা নিয়ে র্দীঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় নিয়ে উদাসীনতা দেখিয়ে আসছেন। সর্বশেষ আপিলাত ট্রাইব্যুনাল নিজ উদ্যোগে উচ্চ আদালত থেকে মামলার সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করে। পরে প্রতিষ্ঠান নগদ ২ শতাংশ ও ব্যাংক গ্যারান্ট্রির ২ শতাংশ টাকা জমা না দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের আপিল খারিজ করে দেয়। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে আদেশের কপি বন্ড কমিশনারেটে প্রেরণ করা হলেও ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ে কমিশনারেটের কর্মকর্তারা ঘুমে রয়েছেন, এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বন্ড কমিশনারেট সূত্রমতে, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পায় কমিশনারেট। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান এই তিন অর্থবছর যে কাঁচামাল আমদানি করেছে, বন্ড গুদামে ছয় হাজার তিন মেট্রিক টন কাঁচামাল কম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে তা অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এই কাঁচামালের উপর প্রযোজ্য শুল্ককর ২৭ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার ৪৬ টাকা। প্রতিষ্ঠান ২০১২ ও ২০১৫ সালে দুইটি বিল অব এন্ট্রিতে আমদানি করা কাঁচামাল বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়নি। সেই কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এই কাঁচামালের উপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৩১ কোটি ৩৪ লাখ ৩০৮ টাকা। আবার প্রচ্ছন্ন রপ্তানির শর্তানুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রায় স্থাপিত বিবিএলসির বিপরীতে রপ্তানি না করে বাংলাদেশি মুদ্রায় শতভাগ মার্জিনে ক্যাশ আইএলসি করে পণ্য রপ্তানি দেখিয়েছে। অর্থাৎ পণ্য রপ্তানি না করেও রপ্তানি দেখিয়েছে। তিন অর্থবছর রপ্তানি দেখানো এই কাঁচামালের উপর প্রযোজ্য শুল্ককর মোট ২৪৪ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪৬ টাকা। এর মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছর ৮৮ কোটি এক লাখ ২১ হাজার ৭৪ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৯১ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ৫০৬ টাকা ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৬৪ কোটি ২৬ লাখ ৮৮ হাজার ১৬৬ টাকা। এই তিন অর্থবছর মোট ৬৪২ কোটি ৮৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৪৮ টাকার কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ, বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি না করে খোলাবাজারে বিক্রি ও রপ্তানি না করেও রপ্তানি দেখিয়েছে। যার উপর মোট শুল্ককর ২৭১ কোটি ৭২ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ টাকা।

সূত্র আরও জানায়, এই শুল্ককর আদায়ে প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠানের আপত্তির কারণে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদন ও প্রতিষ্ঠানের জবাব, কাগজপত্র পর্যালোচনা করে ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার ফৌজিয়া বেগম বিচারাদেশ দেয়। এতে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও শুল্ককর ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৮০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা বিমোচন জরিমানা করা হয়। অর্থদণ্ড ও জরিমানাসহ মোট ৩৭১ কোটি ৭২ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ টাকা জমা দিতে প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দেয়।

এনবিআর সূত্রমতে, বন্ড কমিশনারেটের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ওই সময় কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপীলাত ট্রাইব্যুনালে আপীল দায়ের করে। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, আপীল করতে হলে প্রতিষ্ঠানকে বন্ড কমিশনারেটের দাবি করা বা রায় দেয়া রাজস্বের ২ শতাংশ অর্থ নগদ (স্ট্যাটুটরি ডিপোজিট) সরকারি কোষাগারে জমা ও ২ শতাংশ ব্যাংক গ্যারান্ট্রি দিতে হবে। ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠানকে এই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে ১৬ নভেম্বর আদেশ দেয়। একইসঙ্গে জমার কপি ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে দাখিলের নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সরকারি কোষাগারে কোনো টাকা জমা দেয়নি। বরং ট্রাইব্যুনালের এই আদেশের উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালত ট্রাইব্যুনালের ১৬ নভেম্বর দেয়া আদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। ২০১৯ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত আদালত ছয়বার ছয় মাস করে স্থগিতাদেশ দেয়। ২৩ সেপ্টেম্বর আদালত এক বছরের জন্য স্থগিতাদেশ দেয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।

সূত্রমতে, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হলেও বন্ড কমিশনারেট বা প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করেনি। অভিযোগ রয়েছে, বন্ড কমিশনারেটের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে ম্যানেজ করে রাখে প্রতিষ্ঠান। পরে ট্রাইব্যুনাল নিজ উদ্যোগে উচ্চ আদালত থেকে মামলার সার্টিফাইড কপি উত্তোলন করে। র্দীঘ প্রায় সাত বছরের বেশি সময় আপিলকারী প্রতিষ্ঠান ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুযায়ী স্ট্যাটুটরি ডিপোজিট সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের দেয়া আদেশ প্রতিপালন করেনি। ফলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে চলতি বছরের ১ এপ্রিল আপিল মামলাটি খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এর ফলে প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ে কোনো বাঁধা রইল না।

অভিযোগ উঠেছে, ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট (বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট) এই রাজস্ব আদায়ে উদাসীন। সরকারের পক্ষে রায় হলেও কমিশনারেট থেকে খোঁজ রাখা হয় না। এছাড়া বিপুল পরিমাণ বকেয়া রাজস্ব আদায়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি ট্রাইব্যুনাল রায় দেয়ার পরও কমিশনারেট থেকে কেউ খোঁজ নেয়নি। বরং ট্রাইব্যুনাল নিজ উদ্যোগে মামলা খারিজ করার কপি ও আদালতের কপি বন্ড কমিশনারেটে পাঠিয়েছে।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণ এর কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস বার্তাকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের কপি পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরবর্তী কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, সে বিষয়ে নোট দিয়ে ফাইল কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিন আগে থেকে লক রয়েছে। অপরদিকে, এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন এর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হয়। ফোন রিসিভ করা হলেও কেউ কথা বলেননি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!