এনবিআর বিলুপ্ত না করার দাবিতে মে মাস জুড়ে এনবিআরে আন্দোলন হয়েছে। সিভিল সোসাইটি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পলিসি থিংক-ট্যাংক, কর আইনজীবী সমাজ এবং অংশীজনদের অনেকেও তখন বলেছেন, এনবিআর বিলুপ্ত করা ঠিক হচ্ছে না। অবশেষে ২৫ মে প্রেসনোট জারীর মাধ্যমে সরকার জানায়, এনবিআর থাকছে। রাজস্ব সংস্কারের লক্ষ্যে এনবিআরকে বরং আরো শক্তিশালী করা হবে। স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় উন্নীত করা হবে। সিদ্ধান্তটা ভালো হয়েছে। সরকারকে ধন্যবাদ।
দুই
আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থা ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাওয়া। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা জটিল কাজ। বিভিন্ন রাজস্বের ব্যবস্থাপনা আলাদা, চ্যালেঞ্জ আলাদা। তাই রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়নের কাজ বৃটিশরা ইমপিরিয়াল ব্যুরোক্রেসির একক হাতে না দিয়ে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত ‘বোর্ড’ বা ’কমিটির হাতে দিয়েছে, যাতে একাধিক ব্যক্তির প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে collegial পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিশ্বের প্রাচীন রাজস্ব বোর্ডগুলো তাই বৃটিশদের। বোর্ড অব কাস্টমস (১৬৪৩), বোর্ড অব এক্সাইজ (১৬৪৩), বোর্ড অব ট্যাক্সেস (১৬৬৫), বোর্ড অব স্ট্যাম্পস (১৬৯৪)। আয়কর প্রচলনের পর প্রতিষ্ঠিত বোর্ড অব ইনল্যান্ড রেভিনিউ (১৮৪৯)।
ইন্ডিয়াতেও বৃটিশরা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কাজ বোর্ডের হাতে ছেড়ে দেয়। শুরুতে বোর্ড অব রেভিনিউ (১৭৮৬) ভূমিকরসহ সব ধরনের রাজস্ব দেখতো। পরবর্তীতে কাস্টমস, এক্সাইজ ও আয়কর চলে যায় প্রথমে বোর্ড অব ইনল্যান্ড রেভিনিউ এর হাতে এবং পরে Central Board of Revenue (CBR) (১৯২৪) এর হাতে। এই CBRই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত NBR (১৯৭২) এর পূর্বপুরুষ। বোর্ড কনসেপ্ট বৃটিশদের যুগান্তকারী আবিস্কার। এই কনসেপ্ট বৃটিশ রাজস্ব ব্যবস্থাকে বিশ্বে সেরা করেছে। যুক্তরাজ্যের রাজস্ব এজেন্সি HMRC এখন এই মডেলেই চলছে। ছয়জন কমিশনার ও একজন চেয়ারম্যান মিলে গঠিত একটা নির্বাহী কমিটি HMRC পরিচালনা করে। একটা Advisory Board রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে HMRC-কে পরামর্শ দেয়। HMRC কোনো মিনিস্ট্রি বা ডিভিশন নয়; স্বাধীন ও স্বতন্ত্র non-ministerial পাবলিক বডি।
সবাই জানি, পৃথিবীর সেরা রাজস্ব এজেন্সী বললে HMRC এর নাম আসে।
তিন
রাজস্ব এজেন্সিকে কেন মিনিস্ট্রি বা ডিভিশনের বাইরে স্বতন্ত্র এজেন্সি হিসেবে রাখতে হয়?
রাজস্ব এজেন্সির কাছে নাগরিকের আয়কর রিটার্ন থাকে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের তথ্য থাকে। আয়, ব্যয়, সম্পদ, ব্যাংক হিসাবসহ ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। রাজস্ব এজেন্সি নাগরিকের বাড়ি-ব্যবসায় তল্লাশি করতে পারে। যে কোনো কিছু জব্দ করতে পারে। যে কোনো ধরনের এনফোর্সমেন্ট করতে পারে। মন্ত্রণালয় বা ডিভিশন মূলত মন্ত্রীর অফিস। মন্ত্রীরাই ওখানে ultimate চিফ। সচিবরা হলেন প্রধান প্রশাসনিক ও হিসাব কর্মকর্তা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মন্ত্রীরা দলীয় নেতা। ফলে, রাজস্ব এজেন্সি সরাসরি মন্ত্রীর অধীন থাকলে নিজের দলের লোকদেরকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার কিংবা বিরোধী মতের লোকদেরকে হয়রানি করার সুযোগ থাকে। নাগরিকের নিরাপত্তা ও অধিকার বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা থাকে। এ কারণেই, দেশে দেশে রাজস্ব এজেন্সি বা অন্য এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিকে (যেমন, FBI, CBI, Anti-corruption) মন্ত্রণালয়ের বাইরে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে অরাজনৈতিক প্রধান নির্বাহীর অধীন রাখা হয়। তা না হলে এই পাবলিক ইনস্টিটিউশনগুলো ওয়ার্ক করবে না। এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিক্রিয়ায় টিআইবি বিষয়টা ভালো করে তুলে এনেছিলো।
চার
বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে ক্যাডারগুলো বদ্ধ কুঠুরীর মতো। এক ক্যাডারে ঢুকলে অন্য ক্যাডারের কোনো পদে আর যাওয়া যায় না। রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে সিভিল সার্ভিসের এই structural rigidityও মাথায় রাখতে হবে। এনবিআর ট্যাক্স ও কাস্টমস সার্ভিসের সদর দপ্তর। এই সদর দপ্তরের বিভিন্ন পদ ট্যাক্স ও কাস্টমস সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত (যেহেতু কাজের ধরন বিশেষায়িত)। এনবিআর বিলুপ্ত হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভাগে পরিণত হলে রাজস্বের নতুন সদর দপ্তর সচিবালয় হয়ে যাবে। সচিবালয়ে পুলের উপসচিব ছাড়া অন্য কোনো পদে ট্যাক্স ও কাস্টমস সার্ভিসের লোকদের ঢোকার সুযোগ নেই। কোটার কারণে অন্য ক্যাডারের জন্য উপসচিব পদও বেশি খোলা নেই। এ নিয়ম ভাঙতে হলে জনপ্রশাসন কাঠামোর বড় সংস্কার লাগবে। অনেক রুলস বদলাতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটা অসম্ভবের কাছাকাছি। এটাও এনবিআরের তরফ হতে আপত্তির বড় বিষয় ছিলো।
পাঁচ
রাজস্ব ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্রে থাকে রাজস্ব নীতি। পলিসি ডেস্কের লোকজনই ঠিক করে রিটার্ন ফরম কেমন হবে, উৎস কর কখন কীভাবে আদায় হবে, অডিট-অ্যাসেসমেন্ট কীভাবে করা হবে, শুল্ক বা করের হার কী হবে, জরিমানার বিধান, এনফোর্সমেন্টের বিধান কী হবে।বাস্তবায়নের কাজে গভীর অভিজ্ঞতা না থাকলে ভালো পলিসি করা যায় না। পলিসি করার পর সেটা কাজ করছে কি-না, বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে কি-না, adjustment লাগবে কি-না, তা ফিল্ডের বাস্তবায়ন টীম থেকে constantly জানতে হয়। ভালো রেভিনিউ পলিসি করার জন্য সমাজ, অর্থনীতি, ব্যবসা, বিনিয়োগ বুঝতে হয়। করদাতা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন জনমানুষের সাথে রাজস্ব বোর্ডের প্রাত্যহিক মিথষ্ক্রিয়ার সূত্রে বাস্তবায়নের লোকজনই এটা সবচেয়ে ভালো জানতে পারে। তাই পলিসি ও বাস্তবায়নের মাঝে অভেদ্য দেয়াল তুলে ফেলা যাবে না। পলিসির ফাংশনাল সেপারেশন লাগবে, আবার বাস্তবায়নের সাথে গভীর সম্পর্কও লাগবে। খুব সুচিন্তিতভাবে এই সেপারেশনটা ডিজাইন করতে হবে। এ বিষয়ে এনবিআরের নিজস্ব পরিকল্পনাটা বিবেচনায় নেয়ার মতো। তারা চায়, পলিসির ব্যাকবোনে বাস্তবায়নের কাজে অভিজ্ঞ কাস্টমস ও ট্যাক্স সার্ভিসের লোকজন থাকবে। পাশাপাশি, পলিসির functional independence থাকবে। পলিসির কাজ আমলাতান্ত্রিক না হয়ে রিসার্চ এন্ড ইনোভেশন ধরনের হবে। পলিসি অ্যাডভাইজ দেওয়ার জন্য একটা অ্যাডভাইজরি কমিটি থাকবে যেখানে অর্থনীতিবিদ, বিজনেস লীডার, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন অংশীজনেরা থাকবেন।
ছয়
অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে কৌটিল্য বলেছেন, Kosha Moolo Danda (कोष मूलो दण्ड): রাজকোষই রাষ্ট্রের শক্তির মূল। আসলেই। দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন, সম্মান, সার্বভৌমত্ব, সবকিছুর জন্য শক্তিশালী রাজস্ব ব্যবস্থা অপরিহার্য। আমাদের রাজস্ব পারফম্যান্স নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীসহ অনেকের প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন উঠা অযৌক্তিক না। দেশের ইনফ্লেশন এবং রিয়েল জিডিপি গ্রোথ যোগ করলে নমিনাল রাজস্ব প্রবৃদ্ধি এমনিতে ১৬-১৭ শতাংশ হওয়ার কথা। প্রবৃদ্ধি এর কম হলে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কমে যায়। আর, প্রবৃদ্ধি যদি ইনফ্লেশনের চেয়েও কম হয় তাহলে বুঝতে হবে রাজস্বের degrowth হয়েছে। বাংলাদেশে ঠিক সেটাই ঘটছে। এ বছরেও রাজস্ব আশানুরূপ না। মিডিয়া রিপোর্ট বলছে, জুলাই-মে সময়ে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪.২১ শতাংশ। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানে জুলাই-মে সময়ে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ শতাংশ। ভারতে গত বছরের তুলনায় রাজস্ব বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এই দুটি দেশও বৃটিশ রাজস্ব ব্যবস্থার বোর্ড মডেল অনুসরণ করে। তারা ঠিকই পারছে। আমরা কেন পারছি না? আমাদের মূল সমস্যা আরো অনেক জায়গায়। ৪৫ বছর ধরে এনবিআরে ফুলটাইম CEO নেই। আইআরডি’র সচিব নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ফুলটাইম CEO ছাড়া রাজস্ব এজেন্সী পৃথিবীতে সম্ভবত আর একটাও নেই। আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন যৎসামান্য। ব্যবসা-বাণিজ্য আর লেনদেনের বড় অংশ এখন হয় অনলাইনে, মোবাইল ডিভাইসে, অ্যাপসে। এগুলো ধরার ব্যবস্থা বা সামর্থ এনবিআরের নেই।
বিশ্বায়িত কর ব্যবস্থার আধুনিক কনসেপ্ট কর্মকর্তাদেরকে শেখানোর উদ্যোগ নেই। প্রশিক্ষণ নেই। লজিস্টিকস, অবকাঠামো অপ্রতুল। সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ নেই।
সাত
অথচ এনবিআরের সম্ভাবনা বিপুল। এখানে শতকরা ৮০ ভাগ কর্মকর্তা তরুণ। কথা বলে দেখেছি, তারা একটা নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা গড়তে চায়। যেটা হবে digitally transformed, transparent, citizen-centric, efficient. যেটা হবে বিশ্বমানের। তারা একটা টেকসই রাজস্ব সংস্কার চায়। রাজস্ব সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। আমরা আশাবাদী হই।
শব্বির আহমেদ
কর কমিশনার (চলতি দায়িত্ব)
(ফেসবুক থেকে নেয়া)