প্যাকেট পুরোনো, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে। প্রতি প্যাকেট তিন থেকে ১০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে, যাতে প্যাকেটপ্রতি দুই থেকে সাড়ে সাত টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। বাজেট ঘোষণা হয় ৬ জুন। কিন্তু ৫ জুনের আগেই বিপুল পরিমাণ সিগারেট ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে, যা বাজেট পাসের পরপর বাজারে ছাড়া হয়েছে। সরকারকে পুরোনো দামের প্যাকেটের রাজস্ব দেয়া হলেও বেশি দামে বিক্রির ওপর কোনো রাজস্ব দেয়া হয়নি। এতে শুধু বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ লিমিটেড (জেটিআই) এক মাসে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-মূল্য সংযোজন কর জেটিআই’র পাঁচটি ব্র্যান্ডের ১৬ ধরনের সিগারেট বিক্রির তথ্য যাচাই করে এই ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। শুধু জেটিআই নয়, বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটির প্রায় ২১০ কোটি ৮৬ লাখ ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এরই মধ্যে জেটিআইকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের দাম বা রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। সিগারেট কোম্পানিগুলো বিশেষ করে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটি ও জেটিআই দাম বা মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নেয়। বাজেটের কয়েক মাস আগে থেকে সিগারেটের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি উৎপাদিত সিগারেট ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে যোজসাজশ করে মজুত করা হয়। বাজেট ঘোষণার পরপরই কম দামের সেই সিগারেট বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হয়। এই বিক্রি চলে অন্তত চার-পাঁচ মাস। পুরোনো এসব সিগারেটের ওপর বাড়তি কোনো রাজস্ব পায় না এনবিআর। এ নিয়ে দৈনিক শেয়ার বিজ অনুসন্ধানে নামে। চলতি বছরের ২৭ জুন দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকায় ‘পুরোনো প্যাকেটে নতুন দামে বিক্রি-এক চিঠিতেই বিএটির পকেটে ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এলটিইউ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। ৫ জুনের পরে ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বিক্রি, সেই সিগারেট ও বর্ধিত দামে বিক্রির বিষয়ে তথ্য চেয়ে এলটিইউ জেটিআইকে চিঠি দেয়। একইসঙ্গে বাজেট-পরবর্তী বেশি দামে সিগারেট বিক্রির বিষয়ও খতিয়ে দেখে এলটিইউ। পরে বিষয়টি জানিয়ে ও মতামত চেয়ে এনবিআরের দুই সদস্যকে (মূসক নীতি, মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) এলটিইউ থেকে চিঠি দেয়া হয়। পরে এনবিআর থেকে বলা হয়, বর্ধিত দামের ওপর প্রযোজ্য হারে শুল্ককর আদায় করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউ যাচাই শেষে ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর জেটিআইকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে এলটিইউ।
অপরদিকে এলটিইউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্কহার পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে সর্তকর্তামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৫ জুন মূসক কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের সিগারেটের উৎপাদনস্থল বা কারখানায় গেছেন। সেখান থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউস বা ডিপোর তথ্য নিয়ে আসেন। ৬ জুন বাজেট ঘোষণা হয়। ওই দিন থেকে সিগারেটের স্তরভিত্তিক মূল্য ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। এই বর্ধিত মূল্যের ভিত্তিতে প্রযোজ্য শুল্ককর আরোপযোগ্য হবে। ওয়্যারহাউস বা ডিপোতে ৫ জুন পর্যন্ত মজুতকৃত সিগারেট ক্রেতার কাছে (ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর) কোন মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং কী হারে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছে-এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে জেটিআইকে লিখিত বক্তব্য, হিসাব বিবরণী ও দলিলাদি দিতে তিন দিনের সময় দিয়ে এলটিইউ থেকে ১৪ জুলাই চিঠি দেয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠান ৩০ দিনের সময় চাইলে সাত দিন সময় দেয়া হয়। তবে ১১ সেপ্টেম্বর একটি মূল্যতালিকা দাখিল করে। কিন্তু ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরদের কোন মূল্যে সিগারেট সরবরাহ এবং কী হারে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছে, তার কোনো তথ্য বা প্রমাণক দেয়নি জেটিআই।
এনবিআর সূত্রমতে, ২০২০ সালের অপর এক আদেশ (এসআরও নং-১৪৭) অনুযায়ী, সিগারেটের স্থানীয় সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর প্রযোজ্য হারে উৎপাদনস্থল থেকে সরবরাহের সময় মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো পর্যায়েই সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। অর্থাৎ উপাদনস্থল থেকে যে মূল্যের ওপর মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয়েছে, সেই মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে সিগারেট সরবরাহ করা হলে সেই অধিক মূল্যের ওপর মূসক ও সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য হবে।
এলটিইউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ জুন থেকে সিগারেটের স্তরভিত্তিক বর্ধিত মূল্য ও বর্ধিত সম্পূরক শুল্কহার কার্যকর হয়েছে। ৫ জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউসে মজুত সিগারেট সেই বর্ধিত মূল্যে বিক্রি হওয়ায় বর্ধিত মূল্য ও বর্ধিত সম্পূরক শুল্কহারে প্রদেয় শুল্ককর পরিশোধযোগ্য হবে। জেটিআই’র দাখিল করা তালিকা অনুযায়ী ৫ জুন পর্যন্ত মজুতকৃত সিগারেট ৬ জুন থেকে সরবরাহ-সংক্রান্ত মূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে। জেটিআই’র পাঁচটি ব্র্যান্ডের ১৬ ধরনের সিগারেট বাজারে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ক্যামেল, নেভি, রিয়েল, শেখ ও কেটু। যেমন ৫ জুন পর্যন্ত জেটিআই’র ক্যামেল কানেক্ট ডার্ক ব্ল–, নেভি অপশন (১০এইচএল) ও নেভি ১০ শলাকার সিগারেটের মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে ৬৭ টাকা। কিন্তু ৬ জুন থেকে এই ১০ শলাকার সিগারেট বিক্রি হয়েছে ৭০-৭১ টাকা। অর্থাৎ ১০ শলাকায় বাড়তি নেয়া হয় তিন ও চার টাকা। একইভাবে ক্যামেল কানেক্ট ডার্ক ব্ল–, ক্যামেল কানেক্ট ব্ল– ব্রাস্ট, ক্যামেল কানেক্ট পারপেল ব্রাস্ট, ক্যামেল কানেক্ট লেমন ব্রাস্ট, নেভি অপশন, নেভি ২০ শলাকার সিগারেটের মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে ১৩৪ টাকা, যা ৬ জুন থেকে ১৪০ ও ১৪২ টাকায় সরবরাহ বা বিক্রি করা হয়েছে। এতে প্রতি প্যাকেটে ছয় থেকে আট টাকা বেশিতে বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া রিয়েল (১০এইচএল) ১০ শলাকার ৪৫ টাকার সিগারেট ৫০ টাকা, রিয়েল ২০ শলাকার ৯০ টাকার সিগারেট ১০০ টাকা, শেখ এসএফ (১০এইচএল) ১০ শলাকার ৪৫ টাকার সিগারেট ৫০ টাকা, শেখ এসএফ ২০ শলাকার ৯০ টাকার সিগারেট ১০০ টাকা, শেখ এফএফ (১০এইচএল) ১০ শলাকার ৪৫ টাকার সিগারেট ৫০ টাকা ও শেখ এফএফ ২০ শলাকার ৯০ টাকার সিগারেট ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ জুন পর্যন্ত এবং ৬ জুন থেকে কার্যকর মূল্য, শুল্ককরের পার্থক্যজনিত পরিহারকৃত মূসকের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ৬ জুন থেকে জেটিআই’র ব্র্যান্ড ক্যামেল কানেক্ট ডার্ক ব্ল– ১০ শলাকার সিগারেট সরবরাহ করা হয়েছে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ শলাকা। ১০ শলাকার এই সিগারেটের দাম ৭০ টাকা, যাতে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক ৪৫ টাকা ৮৫ পয়সা, মূসক ১০ টাকা ৫০ পয়সা ও সারচার্জ ৭০ পয়সা। ফলে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ শলাকার ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৫৭ লাখ ৫৫ হাজার ৯২ টাকা, মূসক ১৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ টাকা ও সারচার্জ ৮৭ হাজার ৮৬৪ টাকা। এই ব্র্যান্ডের সিগারেটে মোট শুল্ককর ৭১ লাখ ৬০ হাজার ৯১৬ টাকা। একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি ব্র্যান্ডের ১৬ ধরনের সিগারেট সরবরাহ করেছে ৩৩ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার শলাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২৬৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৫ হাজার ৯২০ টাকা।
অপরদিকে ৫ জুন পর্যন্ত ক্যামেল কানেক্ট ডার্ক ব্ল– ১০ শলাকার সিগারেট সরবরাহ হয়েছে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ শলাকা। ১০ শলাকার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৬৫ শতাংশ। ৬৭ টাকা মূল্যের এই সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৪৩ টাকা ৫৫ পয়সা, মূসক ১০ টাকা ৫ পয়সা ও সারচার্জ ৬৭ পয়সা। সে অনুযায়ী সরবরাহ করা এই সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর দাঁড়ায় ৬৭ লাখ ১১ হাজার ৯৭০ টাকা। আবার বাজেটের পরে ক্যামেল কানেক্ট ডার্ক ব্ল– সিগারেটের ওপর শুল্ককর বেড়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৯৪৬ টাকা।
৫ জুন পর্যন্ত কার্যকর মূল্যের ভিত্তিতে পাঁচটি ব্র্যান্ডের ১৬ ধরনের সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য মোট শুল্ককর ১৫৩ কোটি ৫৪ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৬ টাকা। অর্থাৎ এই টাকা পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠান ওয়্যারহাউস থেকে সিগারেট বের করেছে। আবার ৬ জুন থেকে ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউরদের কাছে বর্ধিত মূল্যে সরবরাহ করা ১৬ ধরনের সিগারেটের ওপর শুল্ককর দাঁড়ায় ২৬৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৫ হাজার ৯২০ টাকা। হিসাব অনুযায়ী বর্ধিত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে জেটিআই ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪ টাকা বেশি নিয়েছে বা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। অর্থাৎ ৫ জুনের আগের সিগারেট মজুত করে রাখা হয়েছে, যা ৬ জুনের পর বিক্রি করা হয়েছে, যাতে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। মূসক আইনের ১২৭(১) অনুযায়ী দাবি করা রাজস্ব পরিশোধের পূর্ব দিন পর্যন্ত প্রযোজ্য হারে সুদ আদায়যোগ্য হবে। সুদ যোগ করা হলে ফাঁকির পরিমাণ বাড়বে।
এই বিষয়ে জেটিআই বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে জানানো হয় যে, “আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর বৃহত্তর করদাতা ইউনিট থেকে একটি কারণ দর্শানোর চিঠি পেয়েছি। বর্তমানে প্রাপ্ত চিঠি এবং তার দাবিগুলো আমরা পর্যালোচনা করছি। বিষয়টির জটিলতার কারণে এই মুহূর্তে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। তবে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সমাধান করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আরও প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার মাত্রই আপডেট সরবরাহ করতে পারবো।“