** দেশের ২০টি রাইস ব্রান মিলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৪ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন, স্থানীয় ভোজ্যতেলের চাহিদার ২৫-৩০% পূরণ করবে রাইস ব্রান অয়েল
** ২০১৯-২০ অর্থবছর রাইস ব্রান রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়, অপরিশোধিত রাইস ব্রান অয়েলের উপর এই শুল্কারোপ না করায় অপরিশোধিত রাইস ব্রান অয়েল ভারতে অবাধে রপ্তানি হচ্ছে
** রমজানকে সামনে রেখে এই তেল রপ্তানিতে শুল্কারোপ করতে সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। একইসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের অনুমতি ছাড়া এই তেল রপ্তানি করা যাবে না
পরিশোধিত ও অপরিশোধিত রাইস ব্রান অয়েল রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। ভোজ্যতেলের ওপর চাপ কমাতে, স্থানীয় বাজারে যৌক্তিক মূল্যে বিকল্প ভোজ্যতেল হিসেবে সরবরাহ বাড়াতে ও ভর্তুকি মূল্যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরবরাহ করার জন্য এ সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে আসন্ন রমজান উপলক্ষে এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে সার্বিকভাবে স্থানীয় বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ ও দামে স্বস্তি তৈরি হবে বলে মনে করে কমিশন। এ সংক্রান্ত চিঠি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে।
সূত্র বলছে, চিঠিতে ট্যারিফ কমিশন রাইস ব্রান এবং অপরিশোধিত ও পরিশোধিত রাইস ব্রান তেলÑএ তিনটি পণ্য রপ্তানিতেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আগের দেয়া শর্ত আরোপের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে, বর্তমানে রাইস ব্রান বা কুঁড়া রপ্তানির ওপরে ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এখন রাইস ব্রানের সঙ্গে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত উভয় ধরনের রাইস ব্রান তেল রপ্তানিতে একই হারে অর্থাৎ ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, রাইস ব্রান মূলত ধানের খোসা ও সাদা চালের মাঝখানের তৈলাক্ত স্তর। এই ব্রান প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে রাইস ব্রান তেল পাওয়া যায়; যা বিশ্বে জনপ্রিয় ও স্বাস্থ্যসম্মত ‘কুকিং অয়েল’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়। তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদিত এ ধান থেকে প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্রান তেল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
কমিশনের হিসাব মতে, বাংলাদেশে ২০১২ সালে রাইস ব্রান তেল উৎপাদন শিল্পে প্রথম বিনিয়োগ হয়। বাংলাদেশ রাইস ব্রান অয়েল মিল অ্যাাসোসিয়েশনভুক্ত ১৭টি এবং অ্যাসোসিয়েশনের বাইরে তিনটিসহ মোট ২০টি মিল রয়েছে। ২০টি মিলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৪ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন। আর বার্ষিক এসব মিল পরিশোধনের ক্ষমতা ৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন। বার্ষিক মোট পরিশোধন ও মোড়কজাতকরণের ক্ষমতা রয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন।
সূত্রমতে, বাংলাদেশ থেকে একসময় রাইস ব্রান তেলের কাঁচামাল রাইস ব্রান রপ্তানি হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় মিলগুলো কাঁচামালের অভাবে চলত না। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে রাইস ব্রান রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ হারে রপ্তানি শুল্কারোপ করা হয়। ফলে রাইস ব্রান রপ্তানি নিরুৎসাহিত হলেও অপরিশোধিত রাইস ব্রান অয়েলের ওপর এই শুল্ক না থাকায় অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রপ্তানি হয়ে আসছে। রাইস ব্রানের উপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করার ফলে রাইস ব্রান রপ্তানি কিছুটা নিরুৎসাহিত হলেও অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল রপ্তানি হয়ে থাকে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, ভোমরা ও হিলি স্থলবন্দর দিয়ে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর ভারতে অপরিশোধিত ৬৪ হাজার ১৯ মেট্রিক টন রাইস ব্রান তেল রপ্তানি হয়েছে। আর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাইস ব্রান রপ্তানি হয়েছে ৭ হাজার ২৮৯ মেট্রিক টন।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, ভোজ্যতেলের স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল করতে রাইস ব্রান তেল ভূমিকা রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও আরবিডি পাম তেলের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার ফলে স্থানীয় বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে প্রাপ্ত রাইস ব্রান হতে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্রান তেল উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এ তেলের একটা বড় অংশ অপরিশোধিত অবস্থায় দেশ থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে। পরিশোধিত বা অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল রপ্তানি হওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় টিসিবি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি মূল্যে রাইস ব্রান তেল সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় বাজারে রাইস ব্রান তেলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং উচ্চমূল্যে অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেলের রপ্তানি উৎসাহিত হওয়ায় স্থানীয় মিলগুলো টিসিবিকে রাইস ব্রান তেল সরবরাহে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে টিসিবি রাইস ব্রান অপরিশোধিত তেল রপ্তানি নিরুৎসাহিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। মন্ত্রণালয় বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিতে ট্যারিফ কমিশনকে অনুরোধ করেছে। কমিশন পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২২ থেকে ২৩ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার বিপরীতে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেল আমদানি করে তা পরিশোধনের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ করা হয়। ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রভাবে স্থানীয় বাজারমূল্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিরাজমান। অপরিশোধিত রাইস ব্রান প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল পাওয়া সম্ভব। আর অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল পরিশোধনের মাধ্যমে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্রান তেল পাওয়া সম্ভব। সম্ভাব্য রাইস ব্রান তেল দ্বারা ভোজ্যতেলের স্থানীয় চাহিদার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করা সম্ভব। এছাড়া পোলট্রি ও ফিশ ফিড উৎপাদনকারী স্থানীয় মিলগুলো অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছে। এতে ফিড উৎপাদনে ব্যবহƒত উপকরণ সহজলভ্য হবে। দেশের অভ্যন্তরে অপরিশোধিত রাইস ব্রান তেল পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের সক্ষমতা রয়েছে। আসন্ন রমজান উপলক্ষে ভোজ্যতেলের বাড়তি চাহিদার প্রেক্ষাপটে রাইস ব্রান তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি হলে সার্বিকভাবে বাজার স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। বিদ্যমান রপ্তানিনীতি অনুসারে রাইস ব্রান, অপরিশোধিত ও পরিশোধিত রাইস ব্রান তেলের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। রাইস ব্রান রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (সিডি) আরোপের মতো পরিশোধিত ও অপরিশোষিত রাইস ব্রান তেলের ওপর ২৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) আরোপ করা প্রয়োজন বলে মনে করে কমিশন।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) ড. মইনুল খান বলেন, ২০১৯ সালে রাইস ব্রান অয়েলের ওপর শুল্কারোপের কথা উঠেছে। তখন শুধু ব্রানের ওপর শুল্কারোপ করা হয়। ব্রান হলো একটি ইন্টারমিডিয়েট পণ্য। সেখান থেকে ক্রুড অয়েল হয়। ক্রুড অয়েলের ওপর করেনি। ফলে ব্রান রপ্তানি হচ্ছে না, রপ্তানি হচ্ছে ক্রুড অয়েল। ফলে স্থানীয়ভাবে আমরা রাইস ব্রান অয়েল পাই না। রাইস ব্রান অয়েল ও ক্রুড হচ্ছে আমাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট, যা রপ্তানি হয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশে সরবরাহ ঘাটতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে সয়াবিন ও পাম অয়েলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে হু হু করে বাড়ছে। আমরা রোজাকে সামনে রেখে ক্রুড অয়েল এবং রিফাইন রাইস ব্রান অয়েল রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের সুপারিশ করেছি। আমরা বলেছি, ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া রাইস ব্রান অয়েল বা ক্রুড অয়েল রপ্তানি করা যাবে না। ফলে স্থানীয় বাজারে এই তেলের সরবরাহ বেড়ে যাবে। ভোজ্যতেলের চাহিদার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রাইস ব্রান অয়েল পূরণ করবে।