** পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার বন্ডের পণ্য নয়, তবুও ঢাকা উত্তর বন্ড কমিশনারেট এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠানকে ২৫০ টনের প্রাপ্যতা দিয়েছে
** পলিস্টার ফ্রেবিক্স বা বোরকার কাপড় এক্সেসরিজের পণ্য নয়, তবুও জংশিনকে ৩৯১ টনের প্রাপ্যতা দিয়েছে উত্তর বন্ড কমিশনারেট
** জংশিনের পলস্টার ফেব্রিক্স ও পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার তৈরির কোনো মেশিনারিজ ও উৎপাদন কিছুই নেই
** জংশিন বন্ড সুবিধার বোরকার কাপড়ের এলসি করে, সেই এলসি পুরান ঢাকার ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে, বন্দর থেকে খালাস হয়ে বোরকার কাপড় যায় ইসলামপুরে
** বন্ড সুবিধার পণ্য অ্যাসেসমেন্ট থেকে খালাস-সব ঘুসের কন্ট্রাকে করে সিঅ্যান্ডএফ দালাল ওবায়দুর রহমান এবং এ কে এম রেজাউর রহমান
** ৩ মাসে ৯ কন্টেইনারে ২০৭ টন পলিস্টার ফেব্রিক্সস, যা সরাসরি বিক্রি হয়েছে ইসলামপুরে, রাজস্ব ফাঁকি হিয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা
** বন্দরে তিনটি পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ও তিনটি পলিস্টার ফেব্রিক্সের মোট ছয়টি চালান খালাসের পর্যায়ে রয়েছে
** ২০১৯ সাল থেকে জংশিন প্রতিবছর প্রায় ১৫-১৮ কন্টেইনার পলিস্টার ফ্রেবিক্সস ৮-১০ কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে আসছে
বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠান। বন্ড সুবিধায় আমদানি করে ‘পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার’। এই পিভিসি ব্যানার শুধু এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠান নয়, এটা কোনো বন্ডেড পণ্য নয়। এটি শতভাগ কর্মাশিয়াল পণ্য, যা দিয়ে নির্বাচন, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামের ব্যানার, ফেস্টুন তৈরি হয়। মূলত প্রিন্টিং প্রেসে এই পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ব্যবহৃত হয়। আবার এই পণ্য তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠানের নেই কোনো মেশিনারিজ, নেই কোনো উৎপাদন। অথচ এক্সেসরিজ এই প্রতিষ্ঠানকে বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা কোন প্রকার যাচাই ছাড়াই ‘প্যাকেজ ঘুস’ নিয়ে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে ইউপি ও প্রাপ্যতা। আর প্রতিষ্ঠান বন্ড বা শুল্কমুক্ত সুবিধার এই পণ্য আমদানি করে রপ্তানি না করে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে সরাসরি রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়া ও পল্টনে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আসছে। বিনিময়ে প্রতি কন্টেইনারে মোটা অংকের টাকা পায় বন্ডেড প্রতিষ্ঠান জংশিন টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেড। জংশিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিঅ্যান্ডএফ এর দালালরা কাস্টমস গোয়েন্দা, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের ‘প্যাকেজ ঘুস’ দিয়ে বের করে আনে। বছরে অন্তত ৮-১০ কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
আবার আমদানি করে ‘পলিস্টার ফ্রেবিক্সস, যা শতভাগ বোরকার কাপড় হিসেবে পরিচিত’। আমদানি করার সঙ্গে সঙ্গে তা চলে যায় রাজধানীর ইসলামপুরে। আবার এই পলিস্টার ফ্রেবিক্সস আমদানি করলেও এই কাপড় পণ্য তৈরির জন্য জংশিনের নেই কোনো মেশিনারিজ। কখনো হয় না উৎপাদন। স্থানীয় গার্মেন্টস থেকে এলসি কিনে ভুয়া এক্সপোর্ট দেখিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবছর বন্ড সুবিধায় অন্তত ১৫-১৮ কন্টেইনার পলিস্টার ফ্রেবিক্সস আমদানি করে গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রতিষ্ঠান জংশিন টেক্সটাইল। এতে বছরে প্রায় ২০-২১ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আসছে। চলতি বছরের তিনমাসে ৯ কন্টেইনারে প্রায় ২০৭ মেট্রিক টন বোরকার কাপড় আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আরো অন্তত ৬টি কন্টেইনার বন্দরে রয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মিথ্যা এইচএস কোড ও ঘোষণার অতিরিক্ত প্রায় ৬ টন বোরকার কাপড় ভর্তি একটি কন্টেইনার প্রায় ১০ লাখ টাকা ‘প্যাকেজ ঘুসের’ বিনিময়ে খালাস করে প্রতিষ্ঠানটি। কাস্টমস গোয়েন্দা, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও হাউসের এআইআর শাখার শত চেষ্টা ‘প্যাকেজ ঘুসের’ কাছে নতি স্বীকার করে। এরই প্রেক্ষিতে বিজনেস বার্তার পক্ষ থেকে অনুসন্ধান শুরু করা হয়। এতে শুধু মিথ্যা এইচএস কোড ও ৬ টন ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্যের চালানটি নয়, জংশিনের বন্ড সুবিধার সকল ধরনের অপকর্ম একে একে বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের মাত্র তিন মাসে ৯ কন্টেইনারে প্রায় ২০৭ টন (২ লাখ ৬ হাজার ৮২৮ কেজি) পলিস্টার ফ্রেবিক্সস আমদানি করেছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এতে শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে প্রায় ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। নয় কন্টেইনারের মধ্যে চলতি বছরের মে মাসে একটি (১৪ মে, বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-৯২১৫৯০, ১৭ হাজার ৫৭৪ কেজি পলিস্টার ফ্রেবিক্স), জুন মাসে তিনটি (২ জুন, বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১০৮৮৭০২, ২৮ হাজার ৩৮৩ কেজি; ১৬ জুন, বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১১৩৮৫৫৬, ২৭ হাজার ৯৯৮ কেজি; ২৪ জুন, বিল এন্ট্রি নাম্বার সি-১১৮৩৭০১, ১ হাজার ১৩০ কেজি), জুলাই মাসে দুইটি (৭ জুলাই, বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১২৬৯৪৭৪, ২৭ হাজার ৯৭৬ কেজি; ১৬ জুলাই, বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১৩৪০৮৩৬, ২১ হাজার ৯৯৯ কেজি) ও আগস্ট মাসে তিনটি কন্টেইনার (১২ আগস্ট, বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১৫১৪৬২৭, ২৫ হাজার ৬৯৫ কেজি; বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১৫১৪৬২৫, ২৮ হাজার কেজি; বিল অব এন্ট্রি নাম্বার সি-১৫১৪৭২৪, ২৮ হাজার ৭২ কেজি) খালাস হয়েছে। ইতোমধ্যে আরো তিনটি কন্টেইনার পলিস্টার ফ্রেবিক্স ও ৩ কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারের এলসি খোলা হয়েছে। এই ছয় কন্টেইনার পণ্য বন্দরে রয়েছে, এখনো খালাস হয়নি।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর বন্ড কমিশনারেট জংশিন টেক্সটাইলকে চলতি বছরের ২৩ মে ২৫০ মেট্রিক টন পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার এর প্রাপ্যতা দিয়েছে। তবে এই প্রাপ্যতা দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠানে এই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরির মেশিনারিজ রয়েছে কিনা, প্রতিষ্ঠান এই পণ্য রপ্তানি করে কিনা-তার কিছুই যাচাই করা হয়নি। প্রায় ১০ লাখ টাকায় প্রাপ্যতা ‘প্যাকেজ ঘুসে’ এই প্রাপ্যতা দেওয়া হয়েছে বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছেন। চলতি বছরের ১৭ মার্চ এই প্রতিষ্ঠানকে ৫২৮ দশমিক ৬৩ মেট্রিক টন প্রাপ্যতা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে পলিস্টার ফ্রেবিক্সস কেবল ৩৯১ দশমিক ৩১ মেট্রিক টন। এই প্রাপ্যতা অনুমোদনে প্রায় ২০ লাখ টাকা ঘুস নেয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান পলিস্টার ফ্রেবিক্সস ছাড়া আর কোনো পণ্য আমদানি করেনি বলে জানা গেছে। এই দুইটি প্রাপ্যতায় সই করেছে সহকারী কমিশনার মো. মালেকীন নাসির আকন্দ।
আরো জানা গেছে, পলিস্টার ফ্রেবিক্সস ঘোষণা দিয়ে বোরকার কাপড় আমদানি করে। আবার সেই কাপড় সরাসরি রাজধানীর ইসলামপুর খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। প্রতিষ্ঠানের ইউপিতে রপ্তানি দেখানো হচ্ছে ব্রা কাপ, ফ্রেবিক্সস কাপ, ফ্রেবিক্সস অ্যান্ড ফোম লেমিনেশন মূলত শুধুমাত্র কাগজপত্রে রপ্তানি দেখানো হলেও প্রকৃত পক্ষে কোন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে না। তবে বন্ডেড এই প্রতিষ্ঠান লোকাল এলসি কিনে-তা রপ্তানি দেখাচ্ছে। পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি ডেমরা কোনাপাড়া এবং ফকিরাপুলে খোলাবাজারে বিক্রি করে। প্রকৃতপক্ষে পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার হলো একটি শতভাগ কর্মাশিয়াল পণ্য, এটি বন্ডের কোনো পণ্য নয়। যা ব্যবহার হয় মানববন্ধন, নির্বাচনসহ অন্যান্য কাজের ব্যানার প্রিন্টের কাজে। অথচ রপ্তানি দেখানো হচ্ছে স্লেটিং এজ বা টাপেটা ট্যাপ, টাপেটা প্রিন্টিং লেবেল ভূয়া রপ্তানি দেখানো হচ্ছে। যা প্রকৃতপক্ষে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি বন্ড থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে প্রাপ্যতা নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মূলত শুধুমাত্র কাগজপত্রে রপ্তানি দেখাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। কোনো পণ্য উৎপাদন করছে না। কেবল লোকাল এলসি কিনে-তা রপ্তানি দেখিয়ে আসছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পলিস্টার ফ্রেবিক্সস বা বোরকার কাপড় এবং পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার এক্সেসরিজ বন্ডের প্রতিষ্ঠানের পণ্য নয়, এটি এক্সেসরিজ খাতে ব্যবহৃত হয় না। জংশিন টেক্সটাইল (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেনিয়েল (জিয়াও হুযাসং) বন্ড কর্মকর্তার যোগসাজসে বন্ড বর্হিভূত পণ্য বন্ড থেকে টাকার বিনিময়ে ইউপি ও প্রাপ্যতা নেয়। পরে সিঅ্যান্ডএফ এর দালাল ওবায়দুর রহমান এবং এ কে এম রেজাউর রহমান বিভিন্ন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, কাস্টমস গোয়েন্দা, কাস্টম হাউসের এআইআর শাখা ঘুসের কন্ট্রাক করে পণ্য খালাস করে আসছে। এই পণ্য সরাসরি ইসলামপুরে খোলাবাজারে চলে যায়। আর চীনের নাগরিক ডেনিয়েল প্রতি এলসিতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পায়, যা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চায়নাতে পাচার করে হুন্ডির মাধ্যমে।
শত বাধার পরও ১০ লাখ টাকায় কন্টেইনার খালাস, ঘুস বন্টনের দায়িত্বে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফুল মিয়া
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জংশিন টেক্সটাইল চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে চীন থেকে বন্ড সুবিধায় চট্টগ্রাম বন্দরে এক কন্টেইনার পণ্য আমদানি করে। ১৬ জুলাই ফরমোশা লজিস্টিকস লিমিটেড নামে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে পণ্য খালাসে অ্যাসাইকুডায় বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে নাম্বার সি-১৩৪০৮৩৬, ২১ হাজার ৯৯৯ কেজি পলিস্টার ফ্রেবিক্সস ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু মূলত কন্টেইনারে ছিলো বোরকার কাপড়। আর ওজন হলো ২৮ হাজার কেজি। অর্থাৎ মিথ্যা এইচএস কোড ও ঘোষণার অতিরিক্ত ৬ হাজার কেজি বা ৬ টন কাপড় কন্টেইনারে বেশি রয়েছে। এই চালানের এলসি জংশিন করলেও টাকা দিয়েছে ইসলামপুরের একজন অবৈধ বন্ডের কাপড় বিক্রেতা। জংশিন এই এলসিতে প্রায় ২০ লাখ টাকা পেয়েছে। জংশিন ও সিঅ্যান্ডএফ এর দালাল হিসেবে পরিচিত ওবায়দুর রহমান এবং এ কে এম রেজাউর রহমান চালানটি খালাসের দায়িত্ব নেয়। তিনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে দ্রুত অ্যাসেসমেন্ট শেষ করে ওইদিন পণ্য খালাসের চেষ্টা করেন। তবে চালানটিতে মিথ্যা এইচএস কোড ও ঘোষণার অতিরিক্ত ৬ টন কাপড় রয়েছে বলে প্রথমে কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়কে একজন তথ্য দেয়। এরই প্রেক্ষিতে চালানটি অ্যাসাইকুডা থেকে লক ও খালাস স্থগিত করে।
অনুসন্ধান বলছে, জংশিন এর প্রতিটি চালান খালাসের সঙ্গে কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দার একজন যুগ্ম পরিচালক (সম্প্রতি কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা থেকে একটি ভ্যাট কমিশনারেটে যুগ্ম কমিশনার হিসেবে বদলি হয়েছে) জড়িত। তিনি প্রতিটি চালান থেকে মোটা অংকের ঘুস নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা চালানটি লক করার পর এই কর্মকর্তা বিচলিত হয়ে উঠেন। পরে কাস্টমস গোয়েন্দার চট্টগ্রামের একজন উপ পরিচালককে (উপ কমিশনার) তিনি দ্রুত চালানটি খালাস করতে বলেন। চালানটি কায়িক পরীক্ষা করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফুল মিয়াকে। মূলত সেই যুগ্ম পরিচালক ফুল মিয়াকে ‘চালানে এইচএস কোডে ঝামেলা নেই, অতিরিক্ত কাপড় নেই’-এমন রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেন। আর কাস্টম হাউসের এআইআর শাখা, কাস্টম হাউসের অ্যাসেসমেন্ট শাখার কর্মকর্তাসহ সবাইকে ম্যানেজ করতে ‘ফুল মিয়াকে’ ১০ লাখ টাকা দিতে বলেন। ইসলামপুরের ওই ব্যবসায়ী ফুল মিয়াকে টাকা দেন। ফুল মিয়া কায়িক পরীক্ষা করে ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে রিপোর্ট দেন, যাতে উল্লেখ করা হয় এইচএস কোড এবং ঘোষিত ওজন সঠিক রয়েছে। তবে কায়িক পরীক্ষার সময় উপস্থিত একাধিক শ্রমিক নিশ্চিত করেছেন যে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টন পণ্য বেশি পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস প্রতিবেদন পাওয়ার পর পণ্য খালাসের উদ্যোগ নেয়। কাপড় কন্টেইনার থেকে তিনটি কর্ভাড ভ্যানে দ্রুত তোলা হয়। এরই মধ্যে এনবিআরসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে খবর পেয়ে মধ্য রাতে খালাস পর্যায়ে এআইআর তিনটি কর্ভাড ভ্যান এনসিটি ইয়ার্ড থেকে আটক করে এবং সিল করে বন্দরের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়। এরই মধ্যে ফুল মিয়া আবার তৎপর হয়ে উঠে। কাস্টমস গোয়েন্দা থেকে চিঠি ম্যানেজ করে কাস্টম হাউসকে দেওয়া হয়। বলা হয়, ফুল মিয়া আবার খালাস পর্যায়ে যাচাই করবেন। এআইআর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে ফুল মিয়ার মাধ্যমে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ দেয়া হয়।সব ম্যানেজ শেষে ফুল মিয়া ও এআইএর এর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বন্দরের স্কেলে তিনটি কর্ভাড ভ্যানের (খালি কর্ভাড ভ্যানের ওজন না নিয়ে পন্য ওজন করা হয় যাতে অতিরিক্ত ৬ টন পন্য ঘোপন করা যায় ) প্রতি খালি গাড়ির ওজন ২ টন করে বেশি দেখিয়ে চালানটি খালাস করে দেন। এই সময় বন্দর কর্মকর্তাকে ফুল মিয়া কর্ভাড ভ্যানের কাছে যেতে দেয়নি। প্রতিবাদ করায় তাদের ‘ভয়’ দেখিয়ে ফুল মিয়া বলেছেন, ‘কে, কি করতে পারবে আমি দেখবো।’ ফুল মিয়া মূলত ৬ টন বেশি থাকা সত্ত্বেও বেশি পাওয়া যায়নি বলে যে ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে-অন্য কেউ কায়িক পরীক্ষা করলে ধরা খেয়ে যাবে, আর ঘুস নেয়ার বিষয়টি ফাঁস হবে, সেজন্য কাউকে কায়িক পরীক্ষা ও খালাস পর্যায়ে কাছে যেতে দেয়নি। শুধু এই চালান নয়, এরপর পরই জংশিন আরো তিনটি চালান একই কায়দায় খালাস নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় তিন মাসে ৯ কন্টেইনার পলিস্টার ফ্রেবিক্স আমদানি করেছে। প্রায় ২৮ হাজার কেজির প্রতি কন্টেইনার ফ্রেবিক্সের মূল্য এক লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর প্রতি কন্টেইনারে শুল্ককরের পরিমাণ প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। সে হিসেবে জংশিনের আমদানি করা নয় কন্টেইনার পলিস্টার ফ্রেবিক্সের মূল্য প্রায় ১৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর নয় কন্টেইনার কাপড়ের প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। খোলাবাজারে বিক্রি করে জংশিন এই শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া ২২ হাজার কেজির প্রতি কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারের আমদানি মূল্য প্রায় ২৫ হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রতি কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫০ লাখ টাকা। তিন কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। উল্লেখ্য, পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার বন্ড সুবিধার পণ্য নয়। এটি কর্মাশিয়াল পণ্য। সেজন্য আমদানি মূল্যের চেয়ে শুল্ককর বেশি।
কাস্টম হাউস সূত্র ও অনুসন্ধান অনুযায়ী, এক্সেসরিজ খাতের বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী জংশিন ২০১৯ সাল থেকে একই কায়দায় পলিস্টার ফ্রেবিক্সস বা বোরকার কাপড় ও পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে আসছে। বন্ড কমিশনারেট থেকে ইউপি ও প্রাপ্যতা দিতে কখনো তাদের রপ্তানি যাচাই করা হয় না। বন্ড কমিশনারেটে ‘ঘুসের কন্ট্রাক’ করে ইউপি ও প্রাপ্যতা নেয়। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় অন্তত ১৫-১৮ কন্টেইনার পলিস্টার ফ্রেবিক্সস ও ৮-১০ কন্টেইনার পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার আমদানি করে। এসব পলিস্টার ফ্রেবিক্সস ইসলামপুর আর পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার ডেমরার কোনাপাড়া ও পল্টনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। এতে প্রতিবছর পলিস্টার ফ্রেবিক্সস বিক্রিতে প্রায় ২০-২১ কোটি এবং পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানার বিক্রিতে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে একাধিক সূত্র বিজনেস বার্তাকে নিশ্চিত করেছে।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে জংশিন টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেনিয়েল এর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন দেওয়া তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এই বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস বার্তাকে বলেন, এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠান কখনোই ফ্রেবিক্সস বা কাপড় আমদানির সুযোগ নেই। এছাড়া পিভিসি ফ্লেক্স ব্যানারও আমদানির সুযোগ নেই। তবে প্রতিষ্ঠানের বন্ডিং অনুমোদনের ক্ষেত্রে এই দুইটি পণ্য রয়েছে কিনা-তা দেখতে হবে। প্রাপ্যতা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মেশিনারিজ, রপ্তানি করে কিনা-তা দেখার কথা। এছাড়া খোলাবাজারে বিক্রি করে কিনা-তাও দেখা দরকার। বন্ড নিশ্চয় ভালো করে যাচাই না করেই প্রাপ্যতা দেওয়া হয়েছে। অসাধু কিছু বন্ড প্রতিষ্ঠানকে কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তা সহযোগিতা না করলে প্রতিষ্ঠানের এত সাহস হতো না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
** ১৪৫ টন বন্ডের কাপড় গোডাউনে ঢুকেনি, সড়ক থেকে ‘হাওয়া’
** ‘বন্ডের পণ্য বাজারে বিক্রি করলেই লাইসেন্স বাতিল’
** টেরিবাজারে জাহাজ থেকে খালাস হয় বন্ডের কাঁচামাল!
** বন্ড দুর্নীতিতে বছরে ৫শ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি
** তিন গার্মেন্টস মালিকের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ
** নেত্রকোনা এক্সেসরিজের ৫ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি