জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো—করনীতি প্রণয়ন এবং কর ব্যবস্থাপনার কাজকে পৃথক করা। এর মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বার্থের সংঘাত কমানো এবং দেশের করভিত্তি আরও বিস্তৃত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সোমবার (১২ মে) রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে, যা সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এই অধ্যাদেশে মূলত রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে সামান্য কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের পাশাপাশি আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এই পরিবর্তন এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এ প্রেক্ষিতে বিষয়টি স্পষ্ট করতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে এনবিআর। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭.৪ শতাংশ, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। তুলনামূলকভাবে, বিশ্বে গড় কর-জিডিপি অনুপাত ১৬.৬ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ার মতো বড় অর্থনীতির দেশেও এই অনুপাত ১১.৬ শতাংশ। দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ১০ শতাংশে উন্নীত করা জরুরি।
প্রেস উইংয়ের মতে, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআরের পুনর্গঠন অপরিহার্য। কারণ, একই সংস্থা যখন করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন—দুই দায়িত্বই পালন করে, তখন তা সংঘাতপূর্ণ এবং কার্যকারিতার দিক থেকে অদক্ষ হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নীতি প্রণয়নে রাজস্ব আদায়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচার, টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর প্রতি উপযুক্ত মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত দুর্বলতা
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, একই প্রতিষ্ঠানের হাতে করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকার কারণে কর ব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কর আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা কার্যকর জবাবদিহির অভাবে কর ফাঁকিদাতাদের সঙ্গে গোপনে সমঝোতায় যেতে পারছেন, যা জনস্বার্থের পরিপন্থী। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যক্তিস্বার্থে কিছু কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁকিদাতাদের সহায়তা করেন। এছাড়া, তাদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের জন্য কোনো নিরপেক্ষ কাঠামো নেই। প্রণোদনা বা পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট ও পরিমাপযোগ্য সূচকের অভাব রয়েছে, ফলে কে কতটা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন, তা নির্ধারণের মানদণ্ডও অনুপস্থিত।
নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক দায়িত্ব একসঙ্গে বহন করার কারণে এনবিআর নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে পারছে না। এর ফলে করজাল বিস্তৃত হচ্ছে না এবং রাজস্ব আহরণও সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম। আইন প্রয়োগে অসঙ্গতি, বিনিয়োগে সহায়তার ঘাটতি এবং সুশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা এনবিআরের প্রতি জনআস্থা কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে আইনের শাসনেও। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রধানই এনবিআরের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন, যা একটি অনিশ্চয়তা ও দক্ষতার ঘাটতির সৃষ্টি করছে। এর ফলে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংস্কার নিয়ে অভিজ্ঞ রাজস্ব ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে—তাঁদের আশঙ্কা, তাঁরা হয়তো গুরুত্বহীন বা কোণঠাসা হয়ে পড়বেন।
সংস্কার থেকে প্রত্যাশিত ইতিবাচক ফল
প্রেস উইং জানিয়েছে, এনবিআরকে ভেঙে দুটি পৃথক বিভাগ গঠন করা হলে দীর্ঘদিনের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে আরও স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। প্রস্তাবিত রাজস্ব নীতি বিভাগ দায়িত্ব পালন করবে কর আইন প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক কর চুক্তি পরিচালনায়। অপরদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ দেখভাল করবে কর আদায়, নিরীক্ষা এবং আইন মেনে চলার বিষয়গুলো। এই দায়িত্ব বিভাজনের ফলে যারা কর নীতির সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা আর কর আদায়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না—ফলে গোপন সমঝোতা কিংবা অনিয়মের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্বে মনোনিবেশ করলে বিশেষায়িত দক্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে; কমবে স্বার্থের সংঘাত।
প্রেস উইং বলেছে, প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়িয়ে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে এবং দক্ষ জনবলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। যদি একটি স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণী ইউনিট গঠন করা যায়, তবে স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব লক্ষ্যের পরিবর্তে তথ্যভিত্তিক এবং দূরদর্শী করনীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। নীতির স্বচ্ছতা, ধারাবাহিকতা ও পেশাদার প্রশাসন দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হবে। এর ফলে বেসরকারি খাতের অভিযোগও কমে যাবে। এনবিআর ভেঙে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; বরং ন্যায়ভিত্তিক ও দক্ষ করব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শক্তিশালী নীতি নির্ধারণ ও স্বচ্ছ প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে।