টানা ১৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ব্যবসা সাত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিতে আওয়ামী লীগ নেতা অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। আবার কোনোটির মালিক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। কখনো এসব প্রতিষ্ঠান ‘নামকাওয়াস্তে’ ডাকা দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। কখনো সরাসরি দরপত্র পদ্ধতিতে এই সাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কার্যত প্রতিযোগিতা না হওয়ায় বন্দরে কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বেশি হয়েছে। বাড়তি ব্যয় পণ্যের দামের ওপর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছেন ব্যবসায়ীরা।
সাত প্রতিষ্ঠানের একটি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত) ও স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয় তিনটি টার্মিনালের ১২টি জেটির মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় ও সরঞ্জামসমৃদ্ধ টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) চারটি জেটি এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) দুটি জেটির নিয়ন্ত্রণ করে সাইফ পাওয়ার টেকের হাতে। জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ছয়টি জেটি বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১৭ বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সাইফ পাওয়ারটেকের পেছনে আ.লীগ নেতারা
সাইফ পাওয়ারটেকের হাতে যে ছয়টি জেটি রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেই বন্দরের ৬৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়। ২০০৬ সালে বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজের হাতেখড়ি হয় সাইফ পাওয়ারটেকের। আওয়ামী লীগ আমলেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও বন্দর কর্মকর্তারা কীভাবে সাইফ পাওয়ারটেককে বন্দরের কাজ পেতে সহযোগিতা করতেন, তার বড় উদাহরণ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা–সংক্রান্ত দরপত্র। বাংলাদেশে প্রথম বন্দরকেন্দ্রিক বিদেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল এই নিউমুরিং টার্মিনালে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে কাজ গুছিয়ে এনেছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্রপ্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। টার্মিনালটি চালু করতে লেগে যায় আরও ছয় বছর। ২০১৫ সালে টার্মিনালটির চার জেটিকে দুই প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দরপত্রের শর্ত এমনভাবে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া আর কেউ যোগ্য নির্বাচিত না হয়।
বন্দর সূত্রে আরও জানা গেছে, তখন একটি দরপত্রে আ জ ম নাছিরের প্রতিষ্ঠান এম এইচ চৌধুরী লিমিটেড (৩০ শতাংশ) ও একরামুল করিম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্স (৩০ শতাংশ) অংশীদার করে সাইফ পাওয়ারটেক। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্রপ্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। টার্মিনালটি চালু করতে লেগে যায় আরও ছয় বছর। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দুটি কাজের চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ৯৯ কোটি টাকা। মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই কাজ দেওয়া হয় সাইফ পাওয়ারটেককে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। সূত্র বলছে, তবে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বিষয়টি ‘ম্যানেজ’ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে নূর-ই-আলম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে গেছেন। শাজাহান খান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। তাই তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় আর কখনো দরপত্র ডাকা হয়নি। বরং সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে ছয় মাস মেয়াদে সাইফ পাওয়ারটেককে কাজ দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে ১১তম বারের মতো সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। সব মিলিয়ে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার কাজের চুক্তিমূল্য দাঁড়িয়েছে ৯০২ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করে কাজ দেওয়া হয়, দরপত্র হয় না।
একইভাবে গত ১৭ বছরে সমঝোতা, দরপত্র ও সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে প্রতিবারই চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের কাজ পেয়েছে সাইফ পাওয়ারটেক। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ছয় বছরের জন্য প্রায় ৩০৪ কোটি টাকায় টার্মিনালটি পরিচালনার কাজ পায় তারা। এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের নভেম্বরে।
সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন বলেন, তাঁরা যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দরপত্রের মাধ্যমে অনেক কাজ পেয়েছেন। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে দেওয়া কাজ তাঁরা করতে চান না। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে বন্দরকে আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, যাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়।’
আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠতার সুযোগে কাজ পাওয়া নিয়ে তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য হলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সালমান এফ রহমানের হস্তক্ষেপে নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার প্রক্রিয়া কেন শুরু হয়েছিল?’
বন্দর সূত্র বলছে, সরকারি কাজে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ছিলেন একটি পক্ষের প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেই পক্ষের বাইরে ছিলেন তরফদার রুহুল আমিন। তবে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে নূর-ই–আলম চৌধুরীর (লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত) সঙ্গে সখ্য রাখতেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের কাছাকাছি যেতে চট্টগ্রাম আবাহনীর পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন তরফদার রুহুল আমিন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম আবাহনীর ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান হন তিনি। এক বছর পর শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনেও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তরফদার রুহুল আমিনের। পরে অবশ্য সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব নামে দলও গঠন করেছেন তিনি। সূত্র বলছে, ফুটবলে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর মহাসচিব শামসুল হক চৌধুরী, যিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরে ১১ বছর ধরে ঢাকার কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও কেরানীগঞ্জে চট্টগ্রাম বন্দরের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনা করে আসছে সাইফ পাওয়ারটেক।