মোহরানার টাকা ও স্বর্ণের পরিমাণ উল্লেখের সুপারিশ

বিয়ের সময় নিকাহনামায় মোহরানার পরিমাণ টাকায় নির্ধারণের পাশাপাশি সমমূল্যে স্বর্ণের পরিমাণও উল্লেখ করতে হবে। পরিশোধের সময় ওই স্বর্ণের পরিমাণের ভিত্তিতে মোহরানার অঙ্ক নির্ধারণ করা হবে। এই সুপারিশটি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ‘আইনের সংস্কার’ অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে ‘মোহরানা ধার্যের বিধান সংশোধন’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, মুসলিম আইনে প্রদত্ত মোহরানাবিষয়ক আইনগত অধিকার সুরক্ষার জন্য বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অপরিশোধিত মোহরানা নির্ধারণ করা যুক্তিসংগত ও ন্যায়সংগত নয়। বর্তমানে, বিয়ের পর যেকোনো সময়ে, এমনকি ২০-২৫ বছর পরেও বিচ্ছেদ হলে নিকাহনামায় উল্লেখিত টাকার অঙ্কের ভিত্তিতে মোহরানা পরিশোধের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। সাধারণত পারিবারিক আদালতে মামলা দায়েরের পরেও একই নিয়মে অপরিশোধিত মোহরানা ধার্য ও পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বাস্তবতা হলো, টাকার ক্রয়ক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই কমে যায়, যার ফলে মোহরানা ধার্যকরণের মূল উদ্দেশ্য, যা তালাকপ্রাপ্ত নারীর ন্যূনতম সুরক্ষা প্রদান, তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।

সুপারিশে সংস্কার কমিশন জানিয়েছে, এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ধারা ১০ সংশোধন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে বিয়ের সময় নিকাহনামায় মোহরানার পরিমাণ টাকায় নির্ধারণের পাশাপাশি সমমূল্যে স্বর্ণের পরিমাণ (ক্যারেটসহ) উল্লেখ করতে হবে এবং পরিশোধের সময় সেই স্বর্ণের পরিমাণের ভিত্তিতে মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। যেহেতু মোহরানা পরিশোধ করা ধর্মীয় দায়িত্ব এবং শুধুমাত্র চুক্তির বিষয় নয়, তাই মোহরানা দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তামাদি আইন প্রযোজ্য হবে না।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল গত বছরের ৩ অক্টোবর। কমিশন তাদের ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ৩১টি অধ্যায়ে নানা সুপারিশ ও প্রস্তাব তুলে ধরেছে।

শিশু আইন সংশোধনের জন্য সুপারিশ

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, শিশু আদালত আইনের সংঘাতে জড়িত শিশুর বিচার করে। তবে একই ঘটনার জন্য শিশুসহ প্রাপ্তবয়স্ক আসামি থাকলে, শিশু আদালত শিশুর বিচার এবং প্রাপ্তবয়স্কের বিচার উপযুক্ত ফৌজদারি আদালত করে থাকে। এতে বিচারগুলো কখনো কখনো বিপরীত হয়। তাই, একই ঘটনায় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক আসামি থাকলে, তাদের বিচার একত্রে শিশু আদালতেই করা উচিত, এজন্য আইনি সংশোধন প্রয়োজন।

কিছু অপরাধে প্রবেশন বা জরিমানা

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির অধিকাংশ ধারায় কারাদণ্ডের সঙ্গে অর্থদণ্ডের উল্লেখ থাকে, যার ফলে ছোটখাটো অপরাধেও প্রথমবার অপরাধী ব্যক্তিকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে, কারাদণ্ডের ফলে সংশোধনের সুযোগ কমে যায়। সুপারিশে সংস্কার কমিশন বলেছে, তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে এমন অপরাধের প্রথমবার সংঘটনের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে প্রবেশন আদেশ বা শুধু জরিমানা দণ্ড দেওয়ার বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

শাস্তিসংক্রান্ত শুনানি ও দণ্ড প্রদান সংক্রান্ত নির্দেশিকা

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে শাস্তি বা দণ্ড বিষয়ে আলাদা শুনানি প্রচলিত। অভিযুক্ত আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর বা অপরাধ স্বীকার করার পর পৃথক তারিখে শাস্তি শুনানি হয়। তবে দেশে বিচারকরা একসঙ্গে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারাগারে পাঠান। সুপারিশে বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধিতে শাস্তিসংক্রান্ত শুনানি পুনঃপ্রবর্তন এবং পৃথক দণ্ড প্রদান নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে হবে।

সাক্ষী ও ভিকটিম সুরক্ষায় সুপারিশ

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ভিকটিম (ভুক্তভোগী) এবং সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় ন্যায়বিচার ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে সাক্ষী সুরক্ষার জন্য কোনো আইন নেই। ভিকটিমও একাধিক মামলার সাক্ষী হন, তবে তাদের সুরক্ষা, খরচ বা ক্ষতিপূরণ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ ধারাও অপ্রতুল। কমিশন এ বিষয়ে তিনটি সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে ভিকটিম ও সাক্ষীসহ তাদের পরিবার ও সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!