চট্টগ্রামে মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউস ‘সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স’-এর আড়ালে পাঁচটি দেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে এক দম্পতির বিরুদ্ধে। অভিযুক্তরা হলেন-সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর খালাতো ভাই মোহাম্মদ মামুন সালাম ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। সিআইডির তথ্যমতে, তারা শুধু ব্যবসায়ীদের অর্থ বিদেশে পাচারেই জড়িত নন, লিবিয়ার মানব পাচার চক্রের মুক্তিপণ সংগ্রহেও ‘গেট কিপার’ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
হুন্ডির মাধ্যমে দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার ও মানব পাচারের মাধ্যমে টাকা পাচারের অপরাধে গত বছরের ১৫ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি। মামলায় মামুন সালাম ও তার স্ত্রী, টাকা পাচারকারী তানভীর হাসান ও তাঁর বড় ভাই মালয়েশিয়া প্রবাসী সজল ইসলামসহ অজ্ঞাত আটজনকে আসামি করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগ। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুবাই, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানির অর্থ ব্যবসায়ীরা সালামের মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন বলে দেখানো হয়েছে। তবে এ টাকার কোনো পণ্য দেশে আসছে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই চ্যানেলে কয়েকশ ব্যবসায়ী নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন দেশের বাইরে। এ ছাড়া সালামের প্রতিষ্ঠানে দেশে টাকা জমা দিয়ে পাচারকারীরা বিদেশ থেকে ডলার নিয়েছেন, যার সত্যতাও পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট সালাম ও কানিজের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের সত্যতা পায়। কিন্তু মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় সে সময় কিছুই করতে পারেনি সংস্থাটি। গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট তৎকালীন আওয়ামী সরকার পতনের পর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে সিআইডি।
তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সালাম-কানিজ দম্পতির ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া অর্থ তারা মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে ই-মানিতে রূপান্তর করেছেন। পরে তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট নম্বরে পাঠিয়ে দেন। বাকি টাকা তারা ব্যাংক থেকে ক্যাশ গ্রহণ করেছেন। এই দম্পতির দুটি ব্যাংকে ‘সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেড’ নামে যৌথ হিসাব নম্বর রয়েছে।
দেশের ভিন্ন ভিন্ন এলাকার কয়েকশ ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসা পণ্যের দাম পরিশোধ করতে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে টাকা দিয়েছেন। যাদের সঙ্গে অভিযুক্তদের কোনো প্রকার ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে অভিযুক্ত তানভীর তাঁর ভাই সজলের কাছে এই চ্যানেলে দেশ থেকে টাকা পাঠান, যা সজল বিদেশি মুদ্রায় গ্রহণ করেন।সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিন বলেন, মানি লন্ডারিং মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। আসামিদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
কোন কোন দেশে টাকা পাচার
চীন থেকে মোবাইলসামগ্রী আমদানির নামে ব্যবসায়ী আল আমিন ৮ লাখ টাকা; ব্যবসায়ী মো. ওয়াজকুরুনী ৮ লাখ; ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানির নামে ব্যবসায়ী সোহেল রানা ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪২৫; কম্পিউটার, সিসি ক্যামেরা ও সফটওয়্যার আমদানির নামে ব্যবসায়ী মানিক চন্দ্র রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার ২০০; তৈরি পোশাক, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকস পণ্যসহ শিশুদের খেলনা আমদানির নামে ব্যবসায়ী নুরে আলম ভূঁইয়া ২১ লাখ; পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানির নামে ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কামাল ৫ লাখ এবং ব্যাগ ও মোটরপার্টস আমদানির নামে ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান ১৬ লাখ টাকা দেশের বাইরে নেন।
অপরদিকে, দুবাই থেকে আসা স্বর্ণের মূল্য পরিশোধে মোজাম্মেল হক হুমায়ূন সাড়ে ৩৬ লাখ টাকা এবং ভারতে চিকিৎসার খরচ বাবদ ৬ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক নাজমুল ইসলাম। এছাড়া, লিবিয়ায় জিম্মিদশায় থাকা স্বামীকে মুক্ত করতে সাদিয়া সুলতানা নামের এক নারী ‘সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স’-এর একটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে মানব পাচার চক্রের সদস্যদের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে জমা দেন ৬ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। একই চ্যানেল ব্যবহার করে, আসামি তানভীর তার ভাই সজলের কাছে দুই দফায় মোট ১ কোটি টাকা পাঠান, যা সজল মালয়েশিয়া থেকে সমপরিমাণ রিঙ্গিত হিসেবে গ্রহণ করেন।