** ৮ মাসে মোবাইল বিক্রির ২৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ভ্যাট রিটার্নে না দেখিয়ে গোপন করেছে
** সুদসহ আট মাসে মোবাইল বিক্রিতে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা
** ভ্যাট রিটার্নে মোবাইলের প্রকৃত বিক্রি ও ভ্যাট ফাঁকির বিষয় স্বীকার করেছে প্রতিষ্ঠান
প্রতিমাসে যে পরিমাণ মোবাইল বিক্রি হয়, তার সঠিক হিসাব মূসক রিটার্নে দেখানো হয় না। কোনো মাসে পৌনে দুই কোটি টাকা। আবার কোনো মাসে সাত কোটি টাকা পর্যন্ত বিক্রি কম দেখানো হয়েছে। এক, দুই মাস নয়-আট মাসে মূসক রিটার্নে অন্তত পৌনে ২৮ কোটি টাকার বিক্রয় গোপন করা হয়েছে। মূলত ভ্যাট ফাঁকি দিতেই এই বিক্রয় গোপন করে আসছে প্রযুক্তি ব্র্যান্ড অপোর। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মূসক গোয়েন্দার অভিযানে বিক্রয় গোপন ও ভ্যাট ফাঁকি বেরিয়ে এসেছে। বিক্রয় তথ্য গোপন ও ভ্যাট ফাঁকি স্বীকার করেছে অপোর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কমিউনিকেশন ইক্যুইপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে মোবাইল সেট আমদানির প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা।
সূত্রমতে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি ব্র্যান্ড অপো। বাংলাদেশের স্মার্টফোনের বাজারে যেসব চীনা ব্র্যান্ড খুব অল্প সময়ে ভালো করেছে, তার একটি হলো অপো। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে অপো। অপোর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কমিউনিকেশন ইক্যুইপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি মোবাইল বিক্রির সঠিক হিসাব মূসক রিটার্নে না দেখিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে গোপন তথ্য পায় মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। বিষয়টি যাচাইয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা একটি প্রিভেন্টিভ টিম চলতি বছরের ১২ মার্চ পুলিশ প্লাজা কনকর্ড টাওয়ারে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অপোর এই প্রতিষ্ঠানের মোবাইল সেট উৎপাদন, বিক্রি ও মূসক সংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করেন। এতে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে ভ্যাট ফাঁকির আলামত পাওয়া যায়। পরে প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ডাটাবেজ হতে মাসভিত্তিক মোবাইল সেট বিক্রির তথ্য প্রিন্ট করে জব্দ করে নেয় কর্মকর্তারা। জব্দ করা কাগজপত্র গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের মাসিক মূসক রিটার্নের সঙ্গে আড়াআড়ি যাচাই ও পর্যালোচনা করে ব্যাপক গরমিল দেখতে পায়। বিশেষ করে ২০২২ সালের জুলাই হতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসের বিক্রয় তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জব্দ করা দলিলাদি অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানটি মোবাইল বিক্রয় করেছে ৬৩ কোটি ৮৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫০ টাকা (ভ্যাটসহ)। কিন্তু ভ্যাট অফিসে জমা দেয়া মাসিক রিটার্নে (দাখিলপত্র) বিক্রয় দেখানো হয়েছে ৬১ কোটি ৮১ লাখ ৬০ হাজার ৩৪৭ টাকা (ভ্যাটসহ)। কেবল জুলাই মাসে বিক্রয় গোপন করেছে দুই কোটি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮০৩ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয় এক কোটি ৯৪ লাখ ৪৫ হাজার ৫২৭ টাকা। যার উপর সুদসহ প্রযোজ্য ভ্যাট ১০ লাখ ৫০ হাজার ৫৮ টাকা। একইভাবে আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রয় ৭৯ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ১৯০ টাকা। কিন্তু মূসক রিটার্নে দেখানো হয়েছে ৭২ কোটি ৮ লাখ ৪১ হাজার ৩৮০ টাকা। বিক্রয় কম দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ৩ লাখ ১৩ হাজার ৮১০ টাকা। যাতে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয় ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৬৫ হাজার ৫৩৩ টাকা। যার উপর সুদসহ ভ্যাট ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৬৫৬ টাকা।
আরও দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে অপোর এই প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রি ১০৫ কোটি ২৬ লাখ ৪৪ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু রিটার্নে এক কোটি ৭৬ লাখ ৮ হাজার ৫৮৬ টাকা বিক্রি কম দেখানো হয়েছে। যাতে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি এক কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার ৮২ টাকা। যার উপর সুদসহ প্রযোজ্য ভ্যাট ৮ লাখ ৮৮ হাজার ৮১৪ টাকা। অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রি ১০১ কোটি ৮১ লাখ ১১ হাজার ৬৯০ টাকা। কিন্তু রিটার্নে ২ কোটি ২৮ লাখ ১০ হাজার ৯২৪ টাকা বিক্রি কম দেখানো হয়েছে। যাতে মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ২ কোটি ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৯০ টাকা। যার উপর সুদসহ প্রযোজ্য মূসক ১১ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৬ টাকা। নভেম্বর মাসে প্রকৃত বিক্রি ১০৭ কোটি ৫১ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ টাকা। কিন্তু রিটার্নে বিক্রি কম দেখানো হয়েছে এক কোটি ৬১ লাখ ৭১ হাজার ১৩১ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি কম দেখানো হয়েছে এক কোটি ৫৪ লাখ এক হাজার ৭৭ টাকা। যার উপর সুদসহ প্রযোজ্য মূসক ৮ লাখ ৮৫৬ টাকা। ডিসেম্বর মাসে প্রকৃত বিক্রি ৭৯ কোটি ৭ লাখ ৬৮ হাজার ১৩০ টাকা। রিটার্নে কম দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার ১৭ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি ৬ কোটি ৮ লাখ ৩১ হাজার ৪৪৫ টাকা। যার উপর সুদসহ মূসক ৩১ লাখ ৩২ হাজার ৮১৯ টাকা।
পর্যালোচনা অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রয় ১১৩ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৬০০ টাকা। রিটার্নে কম দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১৭ লাখ ৯৮ হাজার ২৩৭ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি দুই কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার ২২৬ টাকা। যার উপর সুদসহ মূসক ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭২ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত বিক্রি হয়েছে ৮৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪১০ টাকা। কিন্তু ভ্যাট রিটার্নে বিক্রি কম দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৯০ হাজার ৯৭২ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি ৪ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩০৭ টাকা। যার উপর সুদসহ প্রযোজ্য মূসক ২১ লাখ ৫৯ হাজার ৪২ টাকা। অর্থাৎ মূসক আইন, ২০১২ অনুযায়ী ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে অপোর এই প্রতিষ্ঠানের মোবাইল বিক্রি হয়েছে ৭৩৪ কোটি ৭৩ লাখ এক হাজার ৩৮০ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান মাসিক ভ্যাট রিটার্নে বিক্রি দেখিয়েছে ৭০৬ কোটি ৯৪ লাখ ১৬ হাজার ৯০০ টাকা। আট মাসে প্রতিষ্ঠান বিক্রি গোপন করেছে ২৭ কোটি ৭৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮০ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি ছিলো ২৬ কোটি ৪৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৬ টাকা। যার উপর সুদসহ প্রযোজ্য মূসক এক কোটি ৩৮ লাখ ১৩ হাজার ৫৬৪ টাকা।
এনবিআর সূত্রমতে, অপোর এই প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র পর্যালোচনা ও যাচাই করে ফাঁকি দেওয়া এই মূসক বিষয়ে বক্তব্য জানতে ভ্যাট গোয়েন্দা চলতি বছরের ৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়। ৫ এপ্রিল প্রতিষ্ঠান থেকে চিঠির মাধ্যমে ভ্যাট গোয়েন্দাকে জানানো হয়েছে যে, উদ্ঘাটিত এই মূসক প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় ও স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্নে প্রকৃত বিক্রির তথ্য গোপন করে মূসক ফাঁকির বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে। পরে কোষাগারে ফাঁকি দেয়া এই মূসক সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে অপোর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কমিউনিকেশন ইক্যুইপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেটকে প্রতিবেদন দিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয় অপো বাংলাদেশের জনসংযোগ (পিআর) প্রতিষ্ঠান মাস্টহেড পিআর এর মিডিয়া রিলেশন ম্যানেজার কবির হোসেন এর সঙ্গে। তিনি এই বিষয়ে বিজনেস বার্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন। পরে যোগাযোগ করা হলেও অপোর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।