দেশে টানা সাত মাস ধরে মুঠোফোন ও মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা কমছে। ব্যয়ের চাপ সামলাতে অনেকেই মুঠোফোন ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন করছেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গত সাত মাসে প্রায় ৯৪ লাখ মুঠোফোন গ্রাহক হারিয়েছে দেশ। একই সময়ে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কমেছে ১ কোটি ৩২ লাখ।
মোবাইল অপারেটররা বলছে, ইন্টারনেট ব্যবহার কমে যাওয়ার পেছনে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের কর বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক নতুন কিছু ইন্টারনেট গ্রাহক তৈরি হয়েছিল, সেই প্রবণতাও টেকেনি। মোবাইল অপারেটরদের পুরোনো অনেক সিম নিয়মিতই নিষ্ক্রিয় হয়। সঙ্গে নতুন সিম বিক্রি হয়; কিন্তু সিমের কর বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। এতে নতুন সিম বিক্রি কমে গেছে বলে জানায় অপারেটরগুলো।
রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন সংযোগ নেওয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সংযুক্ত রাখা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত খরচের কারণে বিকল্প সংযোগ নেওয়ার প্রবণতাও কমে গেছে। বর্তমানে মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড মিলিয়ে দেশে মোট ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি, যেখানে গত জুনে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ কোটি ২২ লাখ।
গ্রাহক কত দাঁড়াল
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ৬ মার্চ মুঠোফোন ও ইন্টারনেট গ্রাহকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত জুন মাসে মুঠোফোনের গ্রাহক সর্বোচ্চ ১৯ কোটি ৬০ লাখ ছাড়িয়েছিল। এরপর তা কমতে শুরু করে। জানুয়ারিতে গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৬৬ লাখের মতো।
সবচেয়ে বেশি কমেছে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক। গত জুনে ইন্টারনেট গ্রাহক ছিলেন প্রায় ১২ কোটি ৯২ লাখ। এর পরের মাস থেকেই ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা কমতে থাকে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক কমে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৬০ লাখে।
মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড মিলিয়ে দেশে এখন ইন্টারনেটের মোট গ্রাহক ১৩ কোটির মতো, যা গত জুনে ছিল প্রায় ১৪ কোটি ২২ লাখ। এ সময় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গ্রাহক কিছু বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো। অপারেটররা বলছে, মানুষ কোথাও ওয়াই-ফাই পেলে ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছেন। মুঠোফোনে প্যাকেজ কেনা কমিয়েছেন। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ৯০ দিনের মধ্যে কেউ একবার ব্যবহার করলেই তাঁকে গ্রাহক হিসেবে ধরা হয়।
মোবাইল অপারেটররা বলছে, চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এ কারণে অনেকে ইন্টারনেটে বাড়তি খরচ করতে আগ্রহী নন। অনেকেই একাধিক সিম ব্যবহার করতেন। সেখানে সুবিধা অনুযায়ী ইন্টারনেট প্যাকেজও নেওয়া থাকত; কিন্তু এখন সেটি কমে গেছে। এমনকি ইন্টারনেট প্যাকেজ (এমবি) কার্ডের চাহিদা ও ব্যবহার কমেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে, অর্থাৎ গত জুনে মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছিল। এখন সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও সারচার্জ মিলিয়ে মোট করভার ৩৯ শতাংশের বেশি। সরকার করের সঙ্গে মোবাইল অপারেটরগুলো সেবামূল্যও বাড়িয়েছে।
গ্রাহক কমার পেছনে আরেকটি কারণ বলছে অপারেটররা। সেটি হলো আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলটির নেতা-কর্মীদের একটি অংশের দেশত্যাগ। এই গ্রাহকেরা মুঠোফোনে অনেক টাকা খরচ করতেন। পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। ফলে এসব মানুষের আয়ের ওপর প্রভাব পড়েছে এবং যা মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যায়ও প্রভাব ফেলছে।
আরও কিছু পরোক্ষ প্রভাবের কথা জানায় অপারেটররা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘মানি ফ্লো’ (অর্থ সরবরাহ) আগের মতো নেই। সবাই খুব সাবধানী। এ ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমনটা হয়ে থাকে। গ্রাহক কমে যাওয়ার জন্য সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং উচ্চ হারের ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও সিমের করের কথা জানান গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। অন্যদিকে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, গ্রাহকসংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকলে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে।
মুঠোফোনে খরচ কমিয়েছেন গ্রাহকেরা
দেশের অন্যতম শীর্ষ অপারেটর গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সক্রিয় ডেটা ব্যবহারকারী ছিলেন ৪ কোটি ৯৩ লাখ, যা চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কমে হয় ৪ কোটি ৮০ লাখ।
দেশের অন্যতম অপারেটর রবির আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ফোরজি ডেটা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ, যা দ্বিতীয় প্রান্তিকে ছিল ৩ কোটি ৭৬ লাখ।
মানুষ মুঠোফোনের ব্যয়ও কমিয়েছেন। গ্রামীণফোনের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী তাদের গ্রাহকেরা ব্যয় কমিয়েছেন গড়ে ১৩ টাকা। ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে গ্রাহকের মাসিক ব্যয় ছিল গড়ে ১৬১ টাকা, যা ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে হয়েছে ১৪৮ টাকা। রবির গ্রাহকপ্রতি রাজস্ব ১৪৭ টাকা থেকে কমে ১৪২ টাকা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন এত সংখ্যক গ্রাহক কমার বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ডিজিটালাইজেশনের জন্য এটি ভালো সংকেত নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি মানুষ কি ইন্টারনেট ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।