হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে মোবাইল নেটওয়ার্ক বসাতে ‘অস্বাভাবিক’ শর্ত দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এতে অপারেটররা বিস্ময় প্রকাশ করে বলছে, এভাবে চললে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টার্মিনালে নেটওয়ার্ক চালু অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
বেবিচক জানিয়েছে, টার্মিনালে নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে মোবাইল অপারেটরদের প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশ নিতে হবে। সর্বোচ্চ দরদাতা অপারেটরকেই নেটওয়ার্ক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই অপারেটরকে অন্যদের নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করার দায়িত্বও নিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে বড় অঙ্কের জামানত, মাসিক ভাড়া এবং আয়ের একটি অংশ বেবিচককে ভাগ দিতে হবে।
এই অবস্থায় মোবাইল অপারেটররা বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির হস্তক্ষেপ চেয়েছে। বাংলালিংকের কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান তাইমুর রহমান বলেন, ‘তৃতীয় টার্মিনালে নেটওয়ার্ক বসাতে আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি। এমনকি ডিজাইন ও প্রস্তাব জমাও দিয়েছি। কিন্তু বেবিচক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
তিনি বলেন, সম্প্রতি বেবিচক এমন এক প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক প্রস্তাব চেয়েছে, যা দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনা না করেই প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, নিরাপত্তা জামানত এবং রাজস্ব ভাগাভাগির মতো কঠিন শর্ত দেওয়া হয়েছে। অথচ মোবাইল অপারেটররা আগে থেকেই সরকারের কোষাগারে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব দিচ্ছে। তাইমুর রহমান আরও বলেন, এমন অতিরিক্ত শর্ত টার্মিনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টেলিযোগাযোগ স্থাপনার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
রবির কর্পোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান সাহেদ আলমও বিষয়টি ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে বলেন, এ ধরনের প্রস্তাব আমরা কখনও দেখিনি। আমরা বিস্মিত। বিষয়টি আমরা বিটিআরসিকে জানিয়েছি।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, বেবিচক মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে রাজস্ব শেয়ার নিতে পারে না। টার্মিনালে নেটওয়ার্ক বসাতে বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্টদের যুক্তিসংগত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
বেবিচকের শর্ত
আর্থিক শর্ত হিসেবে বেবিচক যে বিষয়গুলো নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— প্রস্তাবিত মোবাইল অপারেটরকে পর্যাপ্ত লিকুইড অ্যাসেট বা তরল সম্পদের প্রমাণ দাখিল করতে হবে। পাশাপাশি, চুক্তি চলাকালীন প্রতি বছর বর্ধিত হারে অর্থ পরিশোধের পরিকল্পনাও জমা দিতে হবে।
প্রাথমিকভাবে চুক্তির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছর, তবে পারফরম্যান্স সন্তোষজনক হলে মেয়াদ আরও ১০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। অপারেটরকে একটি বিস্তারিত আর্থিক প্রস্তাব জমা দিতে হবে, যেখানে ইন-বিল্ডিং অ্যাক্টিভ ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যান্টেনা সিস্টেম (DAS) কাভারেজ, নতুন সেবা এবং অন্যান্য ভাড়ার খুঁটিনাটি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ছাড়া অপারেটরকে ৩ কোটি টাকার নিরাপত্তা জামানত জমা দিতে হবে। একই সঙ্গে, এয়ারপোর্টের বিভিন্ন এলাকায় (DAS) কাভারেজ বসাতে প্রতি স্কয়ার মিটার অনুযায়ী মাসিক ভাড়ার প্রস্তাবও দিতে হবে।
উল্লেখযোগ্য এলাকাগুলো হলো
তৃতীয় টার্মিনালের ইন-বিল্ডিং কভারেজের আওতায় মোট এলাকা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। এর পাশাপাশি ইসিটি (ICT) কভারেজ ৩৬ হাজার বর্গমিটার, আইসিটি কভারেজ ২৭ হাজার বর্গমিটার এবং মাল্টি-স্টোরিড কার পার্কিংয়ের কভারেজ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪ হাজার বর্গমিটার।
শর্তে বলা হয়েছে, টার্মিনালের অবকাঠামো ব্যবহার করে অন্যান্য মোবাইল অপারেটরদের সংযুক্তি, নতুন ডিজিটাল সেবা চালু এবং অতিরিক্ত আয়ের উৎস থেকে একটি নির্ধারিত অংশ রাজস্ব ভাগ হিসেবে বেবিচককে দিতে হবে। কারিগরি শর্ত অনুযায়ী, অপারেটরকে নিজস্ব খরচে DAS (Distributed Antenna System) স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এবং পুরো টার্মিনাল জুড়ে নিরবিচ্ছিন্ন ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কভারেজ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য ভবনভিত্তিক নেটওয়ার্ক স্থাপনের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক।
প্রস্তাবিত নেটওয়ার্কে একাধিক স্পেকট্রাম ব্যান্ড, বিভিন্ন ধরনের রেডিও প্রযুক্তি এবং ম্যাসিভ-MIMO (Multiple-Input Multiple-Output) সাপোর্ট থাকতে হবে। এটি দেশের সব মোবাইল অপারেটরের ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে এবং অন্য অপারেটরদের সেবাও নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, এটি ভবিষ্যতে ফাইভজি প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী হতে হবে। একই সঙ্গে নেটওয়ার্কটি সাইবার নিরাপত্তা ও ঝুঁকিমুক্ত থাকার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব এবং মানব ও প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হতে হবে।
একটি সমন্বিত মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হবে, যার মাধ্যমে সব অপারেটর একযোগে নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। অপারেটরকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের অনুমোদন নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করতে হবে এবং তার ব্যয়ও বহন করতে হবে। আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর, সিভিল, বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক নির্মাণকাজের খরচ, বিদ্যুৎ, তার সংযোগ ও অন্যান্য সেবার ব্যয়ও সম্পূর্ণভাবে অপারেটরের ওপর বর্তাবে, যার জন্য বেবিচকের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক।