মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসির দাম বাড়তে পারে

বিদ্যমান আয়কর দ্বিগুণ হচ্ছে

** আয়কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে, সহসাই সংশোধিত আদেশ জারি হতে পারে
** আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে বর্ধিত করারোপ কার্যকর হতে পারে
** ২০৩২ সাল পর্যন্ত করছাড় সুবিধা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ কর বাড়ানোর ফলে শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা

বর্তমানে দেশে উৎপাদিত মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্যের মধ্যে কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে এসব ভারী শিল্প দেশে স্থাপিত হয়েছে। এসব শিল্প স্থাপনে সরকার বিপুল পরিমাণ কর, ভ্যাট ছাড় দিয়েছে। এছাড়া এসব শিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পণ্য আমদানি করতে হয়। সেক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে এবার করছাড় কিছুটা তুলে নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এসব খাতে করছাড় ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এনবিআর বলছে, করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে এনবিআর বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। করছাড় দেওয়ার ফলে এসব শিল্প এখন অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়েছে। সেজন্য ছাড়ের পরিমাণ কমিয়ে কিছুটা কর আদায়ের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর দ্বিগুণ করা হলে শিল্পে প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। পণ্যের দামেও যার প্রভাব পড়তে পারে।

এনবিআর সূত্রমতে, সম্প্রতি প্রায় ৬৫টির বেশি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। মূলত আইএমএফ এর শর্ত পরিপালনের অংশ হিসেবে এসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। ভ্যাট খাতের পর এবার আয়কর খাতেও হাত দেওয়া হয়েছে। সেজন্য মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি ও কম্প্রেসার তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান কর দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্তমানে এ ধরণের শিল্প তাদের আয়ের উপর ১০ শতাংশ কর দিচ্ছে। এবং শিল্পের মেশিনারিজ, পার্টস ও ইক্যুইপমেন্ট আমদানিতে ২ শতাংশ হারে কর দিচ্ছে, যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত থাকার কথা ছিলো। এই করহার দ্বিগুণ করা হতে পারে, যা আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর হতে পারে। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান আদেশটি বাতিল করে চলতি সপ্তাহে নতুন আদেশ জারি করা হতে পারে। তবে ইমপোর্ট স্টেজে এআইটি বাড়ানো হলে তা আদেশ জারির দিন থেকেই কার্যকর হবে।

সূত্র আরও জানায়, খুচরা যন্ত্রাংশসহ পূর্ণ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, মোটরসাইকেল, এয়ার কন্ডিশনার ও কম্প্রেসার তৈরির প্রতিষ্ঠানকে করছাড় দিয়ে ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর এনবিআর থেকে আদেশ জারি করা হয়েছে। যাতে শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে ৩০৩২ সালের ৩০ জুন পর্যআন্ত কর হ্রাস করে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। উৎপাদনের তারিখ হতে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আয়ের উপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হতো। তবে এর আগে ২০০৯ সাল থেকে এসব খাতকে করছাড় দিয়ে আসছে এনবিআর। সে সময় ৫ শতাংশ হারে কর দিতো হতো। এছাড়া এসব শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স করা হয় ২ শতাংশ।

এই বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আদেশ জারি হলে বর্ধিত আয়কর ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর হলেও আমদানি পর্যায়ে নতুন আয়কর আদেশ জারির দিন থেকেই কার্যকর হবে। অবশ্য কর বাড়ানোর বিষয়ে শনিবার থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, তাতে ইঙ্গিত দেয়া বলে জানান এই কর্মকর্তা। এই চার পণ্যের কর বাড়ানো হলে অতিরিক্ত চার হাজার কোটি টাকার আয়কর আদায় বাড়তে পারে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

অপরদিকে, কর বাড়ালে দেশের মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি ইন্ডাস্ট্রির উপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে এবং শেষ পর্যন্ত এই ভার কনজ্যুমারের উপরই পড়বে। সেক্ষেত্রে দাম বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এই বিষয়ে এনবিআরের সাবেক একজন সদস্য জানিয়েছেন, কর বাড়ানো হলে এই প্রেশার আলটিমেটলি পন্যমূল্য বেড়ে যাবে এবং কোম্পানিও কিছুটা চাপে পড়বে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত দেওয়া হলো, তা হঠাৎ করে বাতিল করে দেওয়া হলে বাংলাদেশে ট্যাক্স পলিসি যে বিনিয়োগবান্ধব নয়, তা আবার প্রকাশ হব্লেউল্লেখ করে তিনি বলেন, ট্যাক্স সুবিধা বিবেচনায় নিয়েই একজন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করেছিলেন। এভাবে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন বাংলাদেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা পাঠায়।

একাধিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, যে হারে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়াতে হচ্ছে, তাতে পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। একদিকে উচ্চ মূল্যষ্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমছে, অন্যদিকে ক্রমাগত ট্যাক্স বাড়ানোর কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে। ফলে আমাদের বিক্রিও কমতিরে দিকে। নতুন করে ট্যাক্স বাড়ালে তা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বাজার আরো সঙ্কুচিত হবে। মূলত করছাড় সুবিধা দেওয়ার ফলে ফ্রিজ, এসি, মোটরসাইকেল শিল্পে বিনিয়োগ এসেছে। এখন কর বাড়ানো হলে শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ফ্রিজ ও এসির কম্প্রেসার বাজারজাত করে ওয়ালটন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় ফ্রিজের বাজারে মার্কেট লিডার। এসি তৈরিতেও তারা শক্ত স্থান লাভ করছে। দেশে মোটরসাইকেল খাতে নতুন করে হোন্ডা, টিভিএস, হিরো ও রানার-এ চারটি কোম্পানিতে ম্যানুফেকচারিং শুরু করেছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগও আছে। এছাড়া বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী তৈরি করছে। যার ফলে আমদানি নির্ভরতা প্রতিনিয়ত কমতেছে। অতিরিক্ত করারোপের ফলে এসব উদীয়মান শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। সেজন্য বিষয়টি এনবিআরেকে ভাবা উচিত বলে মনে করেন তারা।

বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে

২০৩২ সাল পর্যন্ত দেওয়া কর সুবিধা ২০২৫ সালে এসে বাতিল করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশিস মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউটেন্টের ম্যানেজিং পার্টনার স্নেহাশিস বড়ুয়া। স্নেহাশিস বলেন, ‘কম করহারের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়েই অনেক স্থানীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তা বিনিয়োগে এসেছেন। এখন অর্থবছরের মাঝে এসে হঠাৎ করহার বাড়িয়ে দিলে পলিসি ইনকন্সিটেন্সির বিষয়টি ফের সামনে আসবে। এভাবে পলিসির পরিবর্তনে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন।’

সাবেক এনবিআর সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেন, ‘রাজস্ব ঘাটতির কারণে আইএমএফের পরামর্শে এনবিআর হয়তো ঢালাওভাবে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে কোনো প্ল্যান ছাড়া হঠাৎ করে কর বাড়ালে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হন। কর বাড়ানোর পর বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য বাধাগুলো—বিশেষত বন্দর, কাস্টমসসহ লজিস্টিকস ক্ষেত্রে—দক্ষতা বৃদ্ধি, স্পিড মানি বন্ধ করার মতো ব্যবসার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা গেলে হয়তো এ ক্ষতি পোষানো সম্ভব হবে।’

বিনিয়োগ এসেছে কর সুবিধা বিবেচনায়

দেশে রেফ্রিজারেটর ও এসির কমপ্রেশর উৎপাদন করে ওয়ালটন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি রেফ্রিজারেটর বাজারেও শীর্ষস্থানীয়, এসিও তৈরি করছে। ওয়ালটনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘হাইটেক পার্কে শিল্প হিসেবে আমাদের কর অব্যাহতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের ওপর যদি করহার বাড়ানো হয়, তাহলে তা শিল্পের জন্য বিপর্যয়কর হবে।’ দেশের মোটরসাইকেল খাতে নতুন করে হোন্ডা, টিভিএস, হিরো ও রানার—এ চারটি কোম্পানি উৎপাদন শুরু করেছে, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগও আছে। রানারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত ভ্যাট, ট্যাক্সের দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা বিবেচনায় নতুন বিনিয়োগ এসেছিল।’ ফেয়ার ইলেক্ট্রনিকসের মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘দেশে এসি এবং ওয়াশিং মেশিনের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এর বাইরে রেফ্রিজারেটরসহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের চাহিদা কমছে।’ দেশে গত দুই বছরে সিঙ্গার, সনি র্যাং গসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন বিনিয়োগ নিয়ে এসেছিল বলে জানান মেসবাহ। তিনি বলেন, ‘একটি স্থানীয় ফ্রিজের দাম ৩০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৩৬ হাজার টাকা হয়ে গেছে। নতুন করে কর বাড়লে এই দাম আরও বাড়বে। কিন্তু এই সময়ে মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় ইনকাম বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি বাড়লে মানুষ আগে খাবারের জন্য খরচ করবে, এরপর ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের জন্য,’ বলেন তিনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!