রাজধানীর গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে দুটি খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ ব্যয়কে আর্থিক ও শৃঙ্খলাবিরোধী হিসেবে উল্লেখ করে প্রায় ২,৬০০ কোটি টাকা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।প্রকল্পটির মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭,৭২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হবে ১৫,৩৮৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে নেওয়া ঋণ থেকে খরচ করা হবে ৩২,৩৩২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।এ ছাড়া, প্রকল্পের পরামর্শক খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হবে। আজ ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৫: সাউদার্ন রুট)’ প্রকল্পটি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভায় উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে এ তথ্য।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোরেলের রুট-৫-এর আওতায় গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত একটি নতুন রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজগেট, আসাদগেট, রাসেল স্কোয়ার, কাওরান বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁও, আফতাবনগর, আফতাবনগর সেন্টার, আফতাবনগর পূর্ব এবং নাসিরাবাদ হয়ে যাবে দাশেরকান্দি পর্যন্ত।গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত ১৩.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ হবে, যেখানে আফতাবনগর সেন্টার থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত আরও ৪.১০ কিলোমিটার উড়াল মেট্রোরেল তৈরি করা হবে। মোট ১৭.২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রুটে ১৫টি স্টেশন থাকবে, যার মধ্যে ১১টি মাটির নিচে এবং ৪টি উড়াল অংশে।সকল প্রক্রিয়া শেষ হলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, কাজ শুরু হলে ২০৩১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডকে (ডিএমটিসিএল)।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান,, মেট্রোরেল প্রকল্পে ‘রিজার্ভ ফর কমিটমেন্ট চার্জ অন লোন’ বাবদ ১২৫.৭৯ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ২,৩৭৫.৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ অপ্রয়োজনীয়, কারণ এগুলো প্রকল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। ফলে এসব খাত বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হবে পিইসি সভায়।এছাড়া, পরামর্শক খাতে ১,৬২৩.৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাবও প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে। বর্তমানে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন ও টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করা হচ্ছে, তাই শুধুমাত্র কনস্ট্রাকশন সুপারভিশনের জন্য এত ব্যয় যৌক্তিক নয় বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। পিইসি সভায় এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ রোববার বলেন, সাধারণত এই দুটি খাতের ব্যয় নির্ধারণ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তবে, সরকারকে কমিটমেন্ট ফি এবং ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই হবে। পরিকল্পনা কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে যে, এত বৃহৎ প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা সঠিকভাবে ধরা হয়েছে। যদি ব্যয়গুলো খুঁটিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়, তবে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, সরকারি তহবিলের মাধ্যমে ৫৪টি যানবাহন ভাড়া বাবদ ১০১.৮১ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ২১টি জিপ, ১৫টি পিকআপ, ১২টি মাইক্রোবাস এবং ৬টি মোটরসাইকেল রয়েছে। এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা পিইসি সভায় প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এছাড়া, সাত বছরের জন্য ২ হাজার বর্গমিটার অফিস ভাড়া বাবদ ১,৩৫০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মেট্রোরেল ভবনের বাইরে হওয়ায় এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পে ইউটিলিটি স্থানান্তর বাবদ ৯৩০ কোটি টাকার প্রস্তাবও রয়েছে, যার ভিত্তি এবং যৌক্তিকতা সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশন জানতে চাওয়ার কথা।
জানা গেছে, প্রকল্পে রোলিং স্টক ও ডিপো ইকুইপমেন্টের জন্য ৪,৬৫৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং মেইন লাইনের সিভিল কাজ, স্টেশন ও ডিপো সিভিল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের জন্য ১৭,৯৮৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল (ই অ্যান্ড এম) খাতে ১২,৯৪৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব খাতে ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে। আরও কিছু খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব এসেছে, যেমন: দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ খাতে ২ কোটি ৯৯ লাখ, রাজস্ব খাতে সম্মানি বাবদ ২ কোটি ৭৫ লাখ, সেমিনার ও কনফারেন্সের জন্য ৫ কোটি, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণে ৮ কোটি ৪০ লাখ, অফিস স্টেশনারির জন্য ১ কোটি ২৬ লাখ এবং লিগ্যাল খাতে ৪৯ লাখ টাকা।