** অ্যাসাইকুডায় এ গাড়ি আমদানির বিল অব এন্ট্রির তথ্য নেই, বিআরটিএতে নেই নিবন্ধনের তথ্য
** মেঘনা গ্রুপ থেকে ওসমান দেড় কোটি টাকায় গাড়ি কিনেছেন, নিবন্ধনের একটি কাগজ ছাড়া কোনো কাগজ নেই
** নিশান সাফারি ব্র্যান্ডের গাড়িকে নিশান পেট্রোল হিসেবে দেখিয়ে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে
বিলাসবহুল নিশান সাফারি ব্র্যান্ডের গাড়ি। কিন্তু বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে নিশান পেট্রোল হিসেবে। অ্যাসাইকুডায় গাড়িটির আমদানির কোনো বিল অব এন্ট্রি নেই। অর্থাৎ আমদানির তথ্য নেই। বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেয়া হলেও তাদের কাছে কোনো কাগজপত্র নেই। আবার প্রায় ৯-১০ কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়িটি মাত্র দেড় কোটি টাকায় বিক্রি করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ। চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর কাছে পানির দামে বিক্রি করা গাড়িটির কোনো সঠিক কোনো কাগজপত্র নেই। একটি বিলাসবহুল গাড়িতে এমন বহু অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বর্তমানে গাড়িটি আটক করে মালিকের জিম্মায় রাখা হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, বিলাসবহুল গাড়িটি পার্টস হিসেবে আমদানি করা হয়েছে। দেশে এনে সংযোজন করা হয়েছে। এ গাড়ি নিয়ে তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রমতে, শুল্ককর ফাঁকি দেয়া একটি বিলাসবহুল গাড়ি চট্টগ্রামের একটি বাসায় রয়েছে বলে সংবাদ পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। এরই ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্ত করেন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পরে বাসার গ্যারেজে গাড়িটি পাওয়া যায়। পরে গাড়িটি মালিকের সাময়িক জিম্মায় রেখে আসা হয়েছে। অর্থাৎ গাড়িটি কাস্টমসের অনুমতি ছাড়া বের করা যাবে না। গাড়ির বর্তমান মালিক চট্টগ্রামের কথিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ওসমান সওদাগর। ওসমান গনি কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তিনি গাড়িটি দেড় কোটি টাকায় মেঘনা গ্রুপ থেকে কিনেছেন। গাড়িটি মেঘনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেঘনা সিড ক্রাসিং মিলস লিমিটেডের নামে ছিল। ৫৬০০ সিসির নিশান জিপ গাড়িটির গায়ে লেখা ‘নিশান পেট্রোল’। নিশান পেট্রোল হিসেবে ২০১৬ সালে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। কিন্তু গাড়ির চেসিস নাম্বার দিয়ে অনলাইনে সার্চ করা হলে দেখায়, গাড়িটি ‘নিশান সাফারি’ ব্র্যান্ডের। সাফারি ব্র্যান্ড হলো পেট্রোল থেকে আরও উন্নতমানের গাড়ি।
২০১৬ সালে গাড়িটি বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নেয়া হলে কেন অ্যাসাইকুডায় আমদানির তথ্য থাকবে না—প্রশ্ন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের। অ্যাসাইকুডাতে আমদানির তথ্য নেই, বিআরটিএতে নিবন্ধনের তথ্য নেই। এর অর্থ হলো—জালিয়াত চক্র গাড়িটি হয়তো ‘পার্টস’ ঘোষণায় আমদানি করে দেশে এনে সংযোজন করেছে। সে জন্য অ্যাসাইকুডায় বিল অব এন্ট্রি নেই। বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন নিতে গাড়ির সিসি উল্লেখ করা হয়নি। ভুয়া কাগজ দিয়ে জালিয়াতি করে নিবন্ধন নিয়ে তা বিআরটিএর সফটওয়্যার থেকে মুছে দেয়া হয়েছে। একদিকে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে বিলাসবহুল গাড়িটি আমদানি করা হয়েছে। দ্বিতীয় রাজস্ব ফাঁকি দিতে নিবন্ধনে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করা হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দার হিসাব অনুযায়ী, এই গাড়িতে শুল্ককর ৫০০ শতাংশ। গাড়িটির আমদানি মূল্য প্রায় দেড় লাখ ডলার হলে শুল্ককর হবে প্রায় ৭ কোটি টাকা।
সূত্রমতে, মোহাম্মদ ওসমান সওদাগর একজন ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী। বর্তমানে তিনি বিদেশে পলাতক। তবে ওসমান হুন্ডি ব্যবসায়ী বলে বেশি পরিচিত।
সূত্রমতে, ওসমান সওদাগর কাস্টমস গোয়েন্দাকে মেঘনা গ্রুপ গাড়ি কেনার একটি ডিড (চুক্তিপত্র) ও একটি হলফনামা দিয়েছেন। মেঘনাও গোয়েন্দাকে একটি কাগজ দিয়েছে; যাতে বলা হয়েছে, তারা গাড়িটি ওসমান সওদাগরের কাছে বিক্রি করেছেন। নিবন্ধনের কাগজে বলা আছে, গাড়িটি প্রথম নিবন্ধন নিয়েছে মেঘনা সিড ক্রাসিং মিলস লিমিটেড। দ্বিতীয়বার নিবন্ধন নিয়েছেন ওসমান সওদাগর। ওসমান সওদাগর গাড়ি কেনার সময় মেঘনাকে একটি হলফনামা দিয়েছেন। যাতে বলা আছে, ‘আমি মেঘনা গ্রুপের নিকট থেকে কাগজপত্রসহ গাড়ি বুঝিয়া পাইলাম। ভবিষ্যতে শুল্ক সংক্রান্ত কোন ঝামেলা বা অন্য কোন ঝামেলা হলে আমি সকল কাগজপত্র উপস্থিত করতে বাধ্য থাকবো।’ নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গাড়ি বিক্রি করা হলে সকল কাগজপত্র দেয়া হয়। তার মানে ওসমান সকল কাগজপত্র পেয়েছেন। তবে ওসমানের কোনো কাগজপত্র নেই বলে তারা জানিয়েছেন।
অপরদিকে, কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মেঘনা গ্রুপ থেকে গাড়িটির কাগজপত্র দিতে গ্রুপের কর্মকর্তাদের বলেন। গ্রুপের কর্মকর্তারা কাস্টমস গোয়েন্দাকে জানান, তারা গাড়িটি নিশান শোরুম থেকে কিনেছেন। শোরুম থেকে গাড়ি কিনলে তাদের কাছে গাড়িটির আমদানিসহ যাবতীয় দলিলাদি থাকার কথা। তবে ওই শোরুম থেকে গাড়ি কেনার কোনো কাগজপত্র মেঘনা গ্রুপ দেখাতে পারেনি। গ্রুপের কর্মকর্তারা মৌখিকভাবে বলেছে, তারা নিশান পেট্রোল হিসেবে নিশান শোরুম থেকে গাড়িটি কিনেছেন। কিন্তু ক্রয়ের কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। শোরুম থেকে কিনলে অবশ্যই কাগজপত্র থাকবে। কাস্টমস গোয়েন্দা মেঘনা বলেছেন, কাগজপত্র দেন, নিশানকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। কিন্তু কাগজপত্র দিতে পারেনি। অপরদিকে, গাড়িটির বিল অব এন্ট্রি, চেসিস নাম্বারসহ অন্যান্য আমদানির কাগজ চেয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে চিঠি দেয়া হয়। হাউস কাস্টমস গোয়েন্দাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, গাড়িটির আমদানির কোনো কাগজ বা বিল অব এন্ট্রি নেই। অথচ গাড়ি খালাসের নিয়ম হলো—অ্যাসাইকুডায় প্রতিটি গাড়িটির বিল অব এন্ট্রি ও চেসিস নাম্বার দেয়া বাধ্যতামূলক।
একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মেঘনা একটি প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ। তারা হয়তো গাড়িটি ‘পার্টস’ হিসেবে আমদানি করে দেশে এনে ‘সংযোজন’ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। না হয় এত দামি গাড়ি মাত্র দেড় কোটি টাকায় তারা কেন বিক্রি করবেন!
এনবিআর সূত্রমতে, চট্টগ্রামের একটি বাসায় একটি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। গাড়িটির নিবন্ধন নম্বর হলো—ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-২৩২৪। গাড়িটি শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে আমদানি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গাড়িটি নিবন্ধনের সময় যে আমদানি দলিলের ভিত্তিতে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে, সেসব কাগজপত্র চেয়ে ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) চিঠি দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। তবে গাড়িটি নিবন্ধনের মূল নথি নেই, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে ২১ নভেম্বর বিআরটিএ কাস্টমস গোয়েন্দাকে চিঠি দিয়েছে।
এ বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দার মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ৯-১০ কোটি টাকার গাড়ি। কারও কাছে কাগজপত্র নেই—তা তো হতে পারে না। ওসমান গনি বলেছেন, তিনি মেঘনা গ্রুপ থেকে কিনেছেন। মেঘনা বলছে, তারা গাড়িটি বিক্রি করেছে। মেঘনা বলুক, তারা গাড়িটি কোথা থেকে কিনেছে। গাড়িটি ঘোষণা দিয়ে আনা হয়েছে, নাকি পার্টস ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছে—তা তদন্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মেঘনা গ্রুপে বিভিন্ন সময় বিদেশি ক্রেতা বা ভিআইপি আসে। তারা কেন গাড়িটি বিক্রি করে দিল? পৃথিবীর মধ্যে প্রতিটি গাড়ির চেসিস নাম্বার হলো ইউনিক। এই চেসিস নাম্বার দিয়ে অনলাইনে সার্চ করলে গাড়িটির যাবতীয় তথ্য চলে আসে। আর অ্যাসাইকুডাতে আমদানি করা গাড়ির চেসিস নাম্বার দেয়া বাধ্যতামূলক। অথচ অ্যাসাইকুডায় আমরা এই গাড়ির বিল অব এন্ট্রি ও চেসিস নাম্বার পাইনি। কাস্টম হাউস ও বিআরটিএতে একটি চক্র রয়েছে—যারা বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি ও নিবন্ধনে জালিয়াতি করেন। ধারণা করা হচ্ছে, কাস্টম হাউসে এই গাড়ি খালাসে কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়নি। অন্য গাড়ির সঙ্গে খালাস করা হয়েছে। পরে ফাইল সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
গাড়ি আমদানিতে বিল অব এন্ট্রি ও চেসিস নাম্বার অ্যাসাইকুডাতে বাধ্যতামূলক হলেও তা অ্যাসাইকুডাতে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত করা হলে বেরিয়ে আসবে আসলে গাড়িটি কীভাবে আমদানি হয়েছে। কাস্টম হাউসের কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি থাকলে তা তদন্ত করে শাস্তি দেয়া হবে। তবে বিলাসবহুল গাড়ির ক্ষেত্রে এ ধরনের অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াইটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেওয়া হলে তিনি জবাবে বলেন, ‘রং নিউজ। উই আর নট সেলস এ্যানি কার অব জিপ।’