জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে উঠে এসেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জুলাই-আগস্টে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৪০০ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে ১১৮ শিশু ছিল। আহত প্রায় ১২ হাজার। হত্যাকাণ্ডে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরাও জড়িত ছিলেন। এটি ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের অনেকে যৌন হয়রানির শিকার হন।
বুধবার জাতিসংঘের জেনেভা কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন প্রকাশের পর মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক জানান, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার বিক্ষোভ দমনের নামে হত্যা, গ্রেফতার ও নির্যাতন চালায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতিসংঘকে তদন্তের আমন্ত্রণ জানায়, যার পর ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের ঘটনাবলী যাচাই করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পরিচালিত হয়। প্রতিবেদনে নির্বিচারে হত্যার প্রমাণ উঠে আসে এবং অভিযুক্তদের বিচারের সুপারিশসহ ৪১ দফা সুপারিশ দেওয়া হয়। এতে আরও বলা হয়, গত সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিসকে নূর মোহাম্মদের রিকশার পাদানিতে করে নিয়ে যাওয়ার স্থিরচিত্রটি প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক, আধা-সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তারা আহতদের চিকিৎসায় বাধা দেয় ও চিকিৎসকদের ভয় দেখায়। শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা এ ঘটনায় সমন্বিতভাবে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত নজরদারি করতেন ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিতেন। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, ডিজিএফআইসহ নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে হত্যা, লাশ গুম ও আটকের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলন চলাকালে ১৪০০ মানুষ নিহত ও হাজারো আহত হয়, আর ১১,৭০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীও শিশুদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এ সময় যারা নিহত হয়েছে, তাদের ১২-১৩ শতাংশই শিশু। শিশু হত্যা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পঙ্গু করা, নির্বিচারে গ্রেফতার এবং অমানবিক নির্যাতন চরম অপরাধ। মানবাধিকার কমিশন মনে করে, বিক্ষোভ এবং ভিন্নমত দমনের কৌশল হিসাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। গুরুতর এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগজনক। কোন মাত্রার মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, তা মূল্যায়নে দেশীয় আইনে ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে জুলাই আন্দোলনে নির্বিচারে হত্যার নির্দেশদাতা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন ব্যক্তিদের বিদ্যমান আইন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ ৪১ দফা সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। এতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। আগস্টের শুরু থেকে পরবর্তী সময়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে হত্যাসহ গুরুতর প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে। যারা এসব করেছে তাদের অনেকের তেমন কিছুই হয়নি।
প্রেক্ষাপট :৫ জুন উচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের ৩০% কোটা পুনর্বহালের রায় দিলে ঢাকায় তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যর্থতা, রাষ্ট্রপরিচালনার অদক্ষতা, দুর্নীতি ও বৈষম্যের ক্ষোভ যুক্ত হয়। জনগণের সমান সুযোগের অভাব বিক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানায়। সরকার বিক্ষোভ দমনে সহিংস শক্তি প্রয়োগ করলে এর প্রতিক্রিয়ায় গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যেখানে বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক নেতৃত্বে আসে।
সশস্ত্র হামলা করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা : জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে সাবেক সরকার ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকরা বিক্ষোভ দমনে শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। ছাত্রলীগকে উৎসাহিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়, যার মধ্যে ছিল লাঠি, ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র। শিক্ষার্থীরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। সরকারের সহিংসতা আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যেখানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে শক্তি প্রয়োগ করে, বিশেষ করে ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বড় বিক্ষোভে।
যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সাধারণ বিক্ষোভ এবং সম্পূর্ণ বন্ধের ডাক দেন, যা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সমর্থন করে। সরকারের প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা বাড়ে, এবং পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে, বিভিন্ন প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বিক্ষোভকারীরা রাস্তা বন্ধ ও স্থাপনা ভাঙচুরের চেষ্টা করলে কিছু অংশ সহিংস হয়ে ওঠে, সরকারি ভবন ও পুলিশকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। ১৮ জুলাই থেকে সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে, এবং ১৯ জুলাই পর্যন্ত নির্বিচারে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এ সময় সাংবাদিকদেরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া এবং আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। জুলাইয়ের শেষে সেনাবাহিনীও অভিযানে অংশ নেয়, এবং পুলিশ ও র্যাব ব্যাপক গ্রেফতার করে। 20 জুলাই সাধারণ কারফিউ জারি করা হয়, তবে বিক্ষোভকারীদের দমন করা সম্ভব হয়নি, ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।
সেনাপ্রধানের বৈঠক : ৩ আগস্ট সেনাবাহিনীর প্রধান সেনা অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে জুনিয়র অফিসাররা বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন। এরপরও সেনাবাহিনী আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সাহায্যে আরও সহিংস হয়ে ওঠে এবং বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বল প্রয়োগের অনুমতি পায়। ৫ আগস্ট ঢাকা মার্চ থামাতে সরকার সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশকে শক্তি প্রয়োগের পরিকল্পনা দেয়, তবে পুলিশ অনেক বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করলেও সেনাবাহিনী ও বিজিবি নিষ্ক্রিয় ছিল, ফলে বিক্ষোভকারীরা নির্বিঘ্নে আন্দোলন চালিয়ে যায়।
গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা ও মানবাধিবার লঙ্ঘন : এ আন্দোলন দমন করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি, যেমন ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিবি, সিটিটিসিইউ, নির্বিচারে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরদারি চালায়। তারা বন্দিদের উপর বল প্রয়োগ করে এবং চিকিৎসাসেবা বাধাগ্রস্ত করে। একই সঙ্গে তারা ইলেকট্রনিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করে, গণমাধ্যমের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এবং ভিকটিমদের ভয় দেখিয়ে নীরব রাখে। এসব ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশনা ও সমন্বয়ের সম্পর্ক ছিল, এবং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রমের সমন্বয় ও নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এই সহিংসতা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ছিল, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও আটক ছিল।
নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের মাধ্যমে যৌন হয়রানি :বিক্ষোভের সময় অগ্রভাগে থাকার কারণে মেয়েরাও নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা হামলার শিকার হন। তারা বিশেষভাবে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়। যার মধ্যে রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক শারীরিক সহিংসতা, ধর্ষণের হুমকি এবং কিছু নথিভুক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত যৌন নির্যাতন। ওএইচসিএইচআর প্রতিশোধমূলক ঘটনা হিসাবে যৌন সহিংসতা এবং ধর্ষণের হুমকি সম্পর্কিত অভিযোগ পেয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) পাশাপাশি নিয়মিত আদালতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার স্বতন্ত্র ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় ১০০ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছে। প্রতিশোধমূলক সহিংসতাসহ অন্যান্য অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা এখনো দায়মুক্তি ভোগ করছে।
হত্যাকাণ্ডের ৬৬ শতাংশ মিলিটারি রাইফেলের গুলিতে : আন্দোলনে নিহতদের ৭৮ শতাংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে। এর মধ্যে আবার ৬৬ শতাংশ মিলিটারি রাইফেলের গুলিতে, ১২ শতাংশ শটগানে। আবার শটগানের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ মেটাল শটগান। ২ শতাংশ নিহত পিস্তলের গুলিতে এবং ২০ শতাংশ অন্যান্যভাবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পুলিশ ও আনসার-ভিডিপি বাহিনী শটগান ব্যবহার করে। আবার নিহত অনেকের শরীরে পাওয়া বুলেটের আঘাতের ধরন থেকে বোঝা যায়, তারা ৭.৬২ূ৩৯ এমএম মাপের সামরিক মানের প্রাণঘাতী গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এই অস্ত্র বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তৈরি করে। অন্যদিকে ৭.৬২ এমএম মিমি ক্যালিবারের গুলি ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। এগুলো সামরিক বাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়। যা সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব ব্যবহার করে।
হাসপাতাল থেকে মরদেহ লুকানো : কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ হত্যাকাণ্ড গোপন করার জন্য হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে লুকিয়ে রাখে। এর মধ্যে কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মরদেহের গুলির চিহ্ন সরিয়ে কোনো রেকর্ড ছাড়াই পুলিশের কাছে সরবরাহ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
যেভাবে রিপোর্ট তৈরি করা হয় :এই প্রতিবেদন তৈরি করতে ২৩০ জন বাংলাদেশির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সরকার, নিরাপত্তা বিভাগ এবং রাজনৈতিক দলের ৩৬ জন কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত। সাবেক ও বর্তমান সিনিয়র কর্মকর্তাদের সরেজমিন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এসব তথ্য ভিডিও, ফটো, মেডিকেল ফরেনসিক বিশ্লেষণ, অস্ত্র বিশ্লেষণসহ অন্যান্য তথ্য দিয়ে যাচাই করা হয়েছে।