ভ্যাট বাড়ালে রেস্তোরাঁ বন্ধের হুঁশিয়ারি, উদ্বেগ

রেস্তোরাঁ খাতে ভ্যাট বৃদ্ধি ও সম্পূরক শুল্ক (এসডি) আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। এই দাবি পূরণ না হলে সারাদেশে রেস্তোরাঁ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি বলেছে, ভ্যাট হার আগের মতো ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা না হলে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করে আগের মতো ৫ শতাংশ করা না হলে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা প্রথমে মানববন্ধন করবেন। তাতে কাজ না হলে সারা দেশে এক দিনের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হবে। এরপরও কাজ না হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হবে। রেস্তোরাঁ ব্যবসার ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সম্পূরক শুল্ক (এসডি) নামে আরও একটি ১০ শতাংশ কর আগে থেকেই আছে। অর্থাৎ ভ্যাট ১৫ শতাংশ ও সম্পূরক শুল্ক (এসডি) ১০ শতাংশ যোগ করা হলে ভোক্তাদের মোট ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে। গুলশান ও বনানীর মানুষেরা এই ভ্যাট দিতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা দেওয়া সম্ভব নয়, বিষয়টি অবাস্তব। পৃথিবীর কোথাও খাবারে এত ভ্যাট নেই।

মালিক সমিতি মনে করছে, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে ভোক্তার কাছ থেকে কোনোভাবেই ২৫ শতাংশ কর আদায় করা সম্ভব নয়। চাইলেই খাবারের দাম বাড়ানো যায় না। অথচ গত সরকারের আমলে পরিষেবার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকদের মজুরি। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জের তো আছেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই রেস্তোরাঁ ব্যবসা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থায় ভ্যাট বাড়লে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।

ইমরান হাসানের অভিযোগ, আগের সরকারের মতো এই সরকারও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। আগেও বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হতো, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করা হতো না; এখনো তার ধারাবাহিকতা বজায় আছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের দিকেও অভিযোগের আঙুল তোলেন তিনি। তিনি বলেন, তারাও কেবল বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। তিনি আরও বলেন, শুধু গত ১৫ বছরে নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারের ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থানে।

ইমরান হাসান আরও বলেন, বিগত দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে বা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ ভ্যাট বাড়িয়ে তিন গুণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভ্যাটের হার বাড়িয়ে কাজ হয় না, এ মন্তব্য করে তিনি বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসার ভ্যাট একসময় ১৫ শতাংশ ছিল, সংগঠনের দাবির কারণে তা ধাপে ধাপে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এতে ভ্যাট আদায় ১৯ শতাংশ বেড়েছিল বলে জানিয়েছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। এখন ভ্যাট হার আবার বৃদ্ধি করা হলে ব্যবসায় প্রভাব পড়বে, পরিণামে ভ্যাট আদায়ও কমে যাবে।

লিখিত বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইমরান হাসান সরকারের নীতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আইএমএফের পরামর্শে পৃথিবীর কোথাও দারিদ্র্য বিমোচন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে এনজিও সরকার হিসেবে আখ্যা দেন ইমরান হাসান। তাঁর অভিযোগ, এই সরকার দারিদ্র্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে চায়। তাতে এনজিও ব্যবসা বাড়বে। দেশে রাজনৈতিক দলের চেয়ে আমলাতন্ত্র বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছে। আগের সরকারের আমলেও এমন অনেক অজনপ্রিয় কাজ করেছে, এখনো করছে। এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।

রেস্তোরাঁর মালিকেরা বলেন, দেশের সব রেস্তোরাঁ ভ্যাটের আওতায় আনতে তারা এনবিআরকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। বর্তমানে দেশে ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার, যদিও নিয়মিত ভ্যাট দিচ্ছে সাড়ে তিন লাখ। ভ্যাটের হার না বাড়িয়ে সবাইকে ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির উপদেষ্টা খন্দকার রুহুল আমিন। এ সময় সমিতির অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও ৪৩টি পণ্যের শুল্কহার বৃদ্ধি নিয়ে ঢাকা চেম্বারের উদ্বেগ

শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ও ৪৩টি পণ্যের শুল্কহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। বৃহস্পতিবার বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা চেম্বার জানিয়েছে, এ সিদ্ধান্তের জেরে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে পণ্যের মূল্য বাড়বে। পরিণামে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে দীর্ঘমেয়াদি কর–সুবিধার পাশাপাশি নীতি ধারাবাহিকতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার মাধ্যমে স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যক বলে মনে করছে তারা।

সম্প্রতি শিল্প ও ক্যাপটিভের প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ টাকা ও ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা বাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি করার প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এ ছাড়া প্রায় ৪৩টি পণ্যের ভ্যাট ও শুল্ককর দ্বিগুণ করার উদ্যোগের পাশাপাশি মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পের আয়কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ঢাকা চেম্বার বলেছে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব নিঃসন্দেহে দেশের শিল্প খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যবসার ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে।

ডিসিসিআই মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে সামগ্রিক বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে যেমন নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমবে, তেমনি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনা বিঘ্নিত হবে। এতে রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। দুর্বল হবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা; কমবে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ। এ ছাড়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার ও কম্প্রেসর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের করহার দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে ডিসিসিআই। এসব খাতের প্রতিশ্রুত কর–সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার কথা থাকলেও তা হঠাৎ যে পরিবর্তন করা হলো, তা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব এবং বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট ও করহার বৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। ডিসিসিআই মনে করে, দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণের লক্ষ্যে সরকার, বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক অগ্রগতির কথা বিবেচনায় রেখে পেট্রোবাংলা প্রস্তাবিত শিল্প খাতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে ডিসিসিআই। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির চাপ হ্রাসের লক্ষ্যে এ মুহূর্তে ভ্যাট ও করহার বাড়ানোর উদ্যোগ পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!