কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকসের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে বড় হচ্ছে গ্লোব গ্রুপ অব কোম্পানি লিমিটেড। ২০০৬ সালে গ্রুপটি এএসটি বেভারেজ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন কোমল পানীয় বাজারে নিয়ে আসে। দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় প্রতিষ্ঠানটির কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংক। আর এসব পণ্যের ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে দ্রুত বড় হয় গ্রুপটি। মাত্র তিন মাসে প্রায় ১৪৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, গ্লোব গ্রুপ অব কোম্পানি লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এএসটি বেভারেজ লিমিটেড গত প্রায় ১২ বছরে ব্যবসার সম্প্রসারণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৯৭২ কোটি টাকার কোমল পানীয়, ফ্রুট ড্রিংস উৎপাদন ও মজুদ এবং মূসক চালান না দিয়ে বিক্রির মাধ্যমে এ বিপুল পরিমাণ মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি বড় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ মূসক ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি একই কায়দায় বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ মূসক ফাঁকি দিয়ে আসছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে এনবিআর। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গ্লোব গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এএসটি বেভারেজ লিমিটেড এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) মূল্য সংযোজন কর শাখার মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ম্যাঙ্গোলি, ইউরো লেমন, ইউরো কোলা, ইউরো অরেঞ্জি, ইউরো লেমনজি, রয়েল টাইগার, ফিজ-আপ, ব্লাক হর্স, ইউরো জিরা ড্রিংস ব্রান্ডের পানীয় উৎপাদন ও বাজারজাত করে। প্রতিষ্ঠানটি এসব পানীয় বিদেশেও রফতানি করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে মূসক পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই প্রেক্ষিতে এনবিআরের অধীনে গঠিত মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স এএসটি বেভারেজের মূসক ফাঁকি উদ্ঘাটন ও ব্যবস্থা নিতে মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়।
সে অনুযায়ী, চলতি বছরের ২১ মার্চ মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের দুটি টিম প্রতিষ্ঠানটির নারায়ণগঞ্জ শিমরাইল সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় কারখানা এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির করপোরেট কার্যালয়ে অভিযান চালায়। অভিযানে পৃথকভাবে জব্দ করা মূসক দলিলাদি, বাণিজ্যিক দলিলে মূসক পরিশোধ সংক্রান্ত ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে মূসক ফাঁকি পাওয়ায় মূসক দলিল, বাণিজ্যিক দলিল, ব্যক্তিগত হিসাব ও অন্যান্য দলিলাদি জব্দ করা হয়। এছাড়া অভিযানে দেখা যায়, মূসক ফাঁকি দিতে প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় তথ্য মূসক রেজিস্টারে সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করেনি।
এতে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ১ মার্চের পর থেকে মূসক ফাঁকি দেওয়ার কৌশলের অংশ হিসেবে উপকরণ ক্রয় ও বিক্রয় রেজিস্টারে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া উপকরণ ক্রয় ও পণ্য বিক্রয়ের তথ্য গোপন জায়গায় সংরক্ষণ করে আসছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি মূসক ফাঁকির এ কৌশল বছরের পর বছর করে আসছে বলে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কারখানায় উৎপাদিত পানীয় ও কাঁচামাল হিসাব মিলিয়ে তালিকা তৈরি করা হয়। এতে ব্যাপক গরমিল পাওয়া যায়।
কারখানায় ২০০ মিলি ম্যাঙ্গোলি কোমল পানীয় পরীক্ষা করে দেখা যায়, এ কোমল পানীয় এর কাঁচামাল হলো বেটা কেরোটিন। মূসক রেজিস্টারে বেটা কেরোটিন দুই হাজার ৯৭৯ কেজি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা ৩১৫ কেজি খুঁজে পায়। প্রায় দুই হাজার ৬৬৪ কেজি কাঁচামাল মূসক রেজিস্টারে উল্লেখ করলেও বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটি এসব ব্যবহার করে ফেলেছে। প্রতি ৩৬ পিস ম্যাঙ্গোলি এর জন্য কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় দুই দশমিক ২৫২ গ্রাম। প্রাপ্ত কাঁচামাল দিয়ে ২০০ মিলির এক হাজার ১৮৩ কেইস ম্যাঙ্গোলি তৈরি করা হয়েছে। প্রতি কেইসের মূল্য ১৫৯ টাকা হিসেবে মোট বিক্রিমূল্য প্রায় ১৯ কোটি টাকা। ম্যাঙ্গোলির মূল্য ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি পণ্যটির ওপর প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে। এভাবে প্রতিটি পানীয় উৎপাদনে কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মূসক ফাঁকি দিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৪৫ কোটি ৬১ লাখ টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
অপরদিকে, প্রতিষ্ঠানটি কোমল পানীয় উৎপাদনে মূসক রেজিস্টারে যে কাঁচামাল উল্লেখ করেছে মূসক কর্মকর্তারা প্রতিটি ব্রান্ডের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বা বেশি কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে বিক্রির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মূসক ফাঁকি দিয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে কর্মকর্তারা। এর মাধ্যমে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা মূসক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত প্রধান পণ্য রয়েল টাইগার উৎপাদনে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে মূল্য ঘোষণা ও কাঁচামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। এতে কাঁচামাল কম-বেশি দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ রেয়াত গ্রহণ করেছে। এছাড়া ইউরো কোলার ক্ষেত্রেও একইভাবে কম-বেশি দেখিয়ে অবৈধ রেয়াত গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি কোমল পানীয় পণ্যে মূল্য ঘোষণার ক্ষেত্রে রেয়াত গ্রহণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রাজস্ব ফাঁকি রোধে পানীয় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কঠোর মনিটরিং করার জন্য মামলায় সুপারিশ করা হয়েছে। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি রয়েল টাইগার ও ব্লাক হর্স দুটিকে কার্বনেট বেভারেজ ঘোষণার মাধ্যমে মূসক ফাঁকি দিয়েছে বলে অভিযোগ পেয়েছে এনবিআর।
এই বিষয়ে এলটিইউর একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এএসটি বেভারেজের বিরুদ্ধে মামলার কপি পেয়েছি। আমরা সহসাই দাবিনামা জারি করব। এর আগেও প্রতিষ্ঠান কোমল পানীয় বিপুল পরিমাণ মূসক ফাঁকি দিয়েছে। মূসক ফাঁকি রোধে নজরদারি বাড়ানো হবে।
এ বিষয়ে গ্লোব গ্রুপ অব কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ বিদেশ থাকায় তার বক্তব্য জানা যায়নি। কোম্পানির পরিচালক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মো. খায়রুল আনাম বলেন, অভিযান হয়েছে। মামলা হয়েছে কি-না জানি না। আর আমি এটা ডিল করি না। তবে চেয়ারম্যান দেশের বাইরে রয়েছে। তিনি দেশে এলে এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
***