ভ্যাট ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত নেয় ‘পেনিনসুলা’

** যানবাহন ও প্রোপার্টিকে কাঁচামাল হিসেবে দেখিয়ে প্রায় ১২ লাখ টাকা অবৈধ রেয়াত নিয়েছে
** প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটায় সঠিকভাবে উৎসে মূসক কর্তন করে না, কঠোর নজরদারির সুপারিশ
** হোটেল ও রেস্টুরেন্টের বিক্রি এবং বারে মদ ও পানীয় বিক্রির ওপর সঠিকভাবে ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করে না

যানবাহন ও প্রোপার্টিকে কাঁচামাল হিসেবে দেখিয়ে নেয়া হয়েছে অবৈধ রেয়াত। খাবার ও মদ বিক্রিতে সঠিকভাবে পরিশোধ করেনি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক। প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্তন করতে হয় উৎসে ভ্যাট। অথচ সঠিকভাবে উৎসে ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের স্বনামধন্য চার তারকা হোটেল দ্য পেনিনসুলা চিটাগংয়ের বিরুদ্ধে এমন অবৈধ রেয়াত গ্রহণ ও ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর নিরীক্ষা করে এই ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত গ্রহণ উদ্ঘাটন এবং প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পুঁজিবাজারে ভ্রমণ ও অবসর খাতের তালিকাভুক্ত পেনিনসুলার বিরুদ্ধে সম্প্রতি এই মামলা করে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদন চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা শতভাগ কমপ্লায়েন্স।

উল্লেখ্য, হোটেল পেনিনসুলার বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুব উর রহমান। তিনি সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা তাহসিন আরশাদ। তিনিও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের আত্মীয়।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা তাহসিন আরশাদের ব্যক্তিগত হোয়াসঅ্যাপ নম্বরে বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি দেশের বাইরে রয়েছি। আর আমি বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নই। আমার অবর্তমানে চেয়ারম্যান মাহবুব উর রহমান দেখভাল করছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, এটি একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি। আমাদের কোম্পানি প্রতিবছর দুটি স্বনামধন্য অডিটেড ফার্ম দিয়ে অডিট করানো হয়। আমরা সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে করে থাকি।

ফাঁকির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পেনিনসুলা চিটাগংয়ের চেয়রম্যান মাহবুব উর রহমান বলেন, ‘এই বিষয়গুলো আমাদের ফিন্যান্সিয়াল ডিপার্টমেন্ট দেখে। আমরা সবকিছু হানড্রেড পার্সেন্ট কমপ্লায়েন্স করি। এরপরও তারা যদি মনে করেন কোনো বিষয়ে আমাদের গ্যাপ আছে, তাহলে বসে সল্ভ্ করা হবে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোটেল পেনিনসুলা একটি হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনে নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয় ভ্যাট গোয়েন্দা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পেনিনসুলার ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও মাসিক দাখিলপত্র নেয়া হয়। এসব কাগজপত্র যাচাইয়ে প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি ও অবৈধ রেয়াত গ্রহণের বিষয়টি উদ্ঘাটন করেন ভ্যাট গোয়েন্দার নিরীক্ষা দলের কর্মকর্তারা। পরে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট পাঁচ বছরের পৃথক দুটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেয়া হয়।
575336200
২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পেনিনসুলার রুম ও হল ভাড়া, স্পা, ট্রান্সপোর্ট, লন্ড্রি, সুইমিং পুল সেবা ও রেস্টুরেন্টে বিক্রির ওপর ভ্যাট রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বারে বিক্রির (মদ ও পানীয়) ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সেবা ও বিক্রির তথ্য বিক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়। এছাড়া প্রতি মাসে দাখিলপত্রে এসব বিক্রি প্রদর্শন করা হয়। নিরীক্ষা দলের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের মাসিক দাখিলপত্র ও বিক্রয় রেজিস্টার তুলনামূলক পর্যালোচনা করেন, যাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত দাখিলপত্রে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি দেখিয়েছে ৮৪ কোটি ৬৭ হাজার ৪৫১ টাকা। বিক্রয় রেজিস্টারে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রি পাওয়া গেছে ৮৪ কোটি সাত লাখ ৮১ হাজার ৯ টাকা। বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য পাওয়া গেছে সাত লাখ ১৩ হাজার ৫৫৮ টাকা, যাতে ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে এক লাখ সাত হাজার ৩৪ টাকা। সুদসহ এই ফাঁকির পরিমাণ এক লাখ ৫১ হাজার ১৯১ টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পেনিনসুলার অবৈধ রেয়াত নেয়ার বিষয়টি নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি যানবাহন ও প্রোপার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়ামে যানবাহন ও প্রোপার্টিকে কাঁচামাল হিসেবে দেখিয়ে রেয়াত নিয়েছে। ভ্যাট আইন অনুযায়ী যানবাহন ও প্রোপার্টি কোনো কাঁচামাল নয়। সেজন্য এর প্রিমিয়ামের ওপর রেয়াত প্রযোজ্য নয়। নিরীক্ষায় দেখা যায়, পেনিনসুলা কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত গাড়ির ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামে এক লাখ ৩৪ হাজার ৯৪৭ টাকা ও সম্পদের প্রিমিয়ামে সাত লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৬ টাকা অবৈধ রেয়াত গ্রহণ করেছে। এই দুই খাতে আইন-বহির্ভূতভাবে রেয়াত নিয়েছে মোট আট লাখ ৯৪ হাজার ৯০৩ টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা মেয়াদে যানবাহন ও প্রোপার্টি ইন্স্যুরেন্সের ওপর পরিশোধিত মূসক গ্রহণ করেছে, যা আইন-বহির্ভূত। বর্তমান আইনেও এসব খাতে রেয়াত গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পেনিনসুলা একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। ভ্যাট আইন অনুযায়ী, লিমিটেড কোম্পানির ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর উৎসে ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে উৎসে ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি স্টাফ ইউনিফর্ম, বার্ষিক সাধারণ সভার ব্যয়, অ্যাসোসিয়েশন ও সদস্য ফি, অডিট ফি, এয়ারপোর্ট গার্ডেন হোটেল ইজারা, ঢাকা অফিস ব্যয়, বিনোদন ব্যয়, বিভিন্ন ফি, রিপেয়ার ও মেইনট্যানেন্স, বিজ্ঞাপন, হোটেল বিল্ডিং, মেশিনারিজ, বিভিন্ন ইক্যুইপমেন্ট, সিকিউরিটি, ফার্নিচার, অফিস ডেকোরেশনসহ প্রায় অর্ধ-শতাধিক খাতে সারাবছর কেনাকাটা বা ব্যয় করে, যাতে উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত কেনাকাটার ক্ষেত্রে ৫৪ লাখ ৪৯৯ টাকা উৎসে ভ্যাট পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুপারিশ বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি কেনাকাটার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে উৎসে মূসক কর্তন করে না। সেজন্য প্রতিষ্ঠানকে কঠোর নজরদারিতে রাখা উচিত।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেনিনসুলা ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বিক্রির ওপর ভ্যাট এক লাখ ৫১ হাজার ১৯১ টাকা, আট লাখ ৯৪ হাজার ৯০৪ টাকা অবৈধ রেয়াত গ্রহণ ও ৫৪ হাজার ৪৯৯ টাকা উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি এই তিন অর্থবছরে মোট ৬৪ লাখ ৪৬ হাজার ৫৯৪ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।

অপর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পেনিনসুলা ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর আগের তিন অর্থবছরের মতো একইভাবে বিক্রির ক্ষেত্রে ভ্যাট ফাঁকি, গাড়ি ও সম্পদের প্রিমিয়ামে অবৈধ রেয়াত গ্রহণ এবং কেনাকাটার ক্ষেত্রে উৎসে মূসক পরিশোধ করেনি। এই দুই অর্থবছরে পেনিনসুলা বিক্রির ওপর এক লাখ ২৯ হাজার ৩৫০ টাকার ভ্যাট, তিন লাখ ছয় লাখ ৯২৯ টাকা অবৈধ রেয়াত গ্রহণ ও দুই লাখ ৪৫৫ টাকা উৎসে মূসক পরিশোধ করেনি। অর্থাৎ এই দুই অর্থবছর মোট ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪ টাকা রাজস্ব পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে পেনিনসুলা ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৩২৮ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

উল্লেখ্য, পেনিনসুলা চিটাগাং ২০১৪ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১১৮ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারসংখ্যা ১১ কোটি ৮৬ লাখ ৬৬ হাজার ৮০০। মোট শেয়ারের মধ্যে ৪৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, দশমিক ১৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে। কোম্পানিটির ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২১-২২ হিসাববছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে আট পয়সা। গতবছর একই সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছিল চার পয়সা। হিসাববছরের প্রথম ৯ মাসে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৭২ পয়সা। গত বছরের একই সময় ৪৬ পয়সা আয় হয়েছিল। চলতি বছরের ৩১ মার্চ কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল ৩০ পয়সা।

** উদ্বোধনের পর থেকে কর-রিটার্ন দেয়নি ‘সায়মন বিচ’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!