** মোবাইল ও মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রির সঠিক হিসাব মাসিক ভ্যাট রিটার্নে দেখানো হয় না
** রাজস্ব ফাঁকি দিতে নেয় অবৈধ ও অতিরিক্ত রেয়াত, মামলা হলে অনিয়ম স্বীকার করে
দামি ও ব্র্যান্ডের মোবাইল, মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রি করা হয়। কিন্তু বিক্রির সঠিক হিসাব মাসিক ভ্যাট রিটার্নে দেখানো হয় না। মূলত ভ্যাট ফাঁকি দিতেই বিক্রির সঠিক হিসাব দেয় না। একটি, দুইটি নয়-১৯টি শো-রুমে একই অবস্থা। রিটার্ন যাচাই আর অভিযান করলেই বিক্রয় তথ্য গোপনের তথ্য বেরিয়ে আসে। মামলা হয়, ফাঁকি স্বীকার করে টাকা জমা দেয়। কিন্তু আবারো একইভাবে বিক্রয় হিসাব গোপন করে। শুধু বিক্রির হিসাব গোপন নয়, রেয়াত জালিয়াতিও করে সমান তালে। ভ্যাট ফাঁকিতে এমন অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠান হলো জনপ্রিয় প্রযুক্তি ব্র্যান্ড ‘গ্যাজেট এন্ড গিয়ার’। সর্বশেষ ভ্যাট গোয়েন্দার অভিযানেও মেলে একই চিত্র। এর আগে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট শো-রুমে অভিযান করলে বিক্রয় গোপনের একই চিত্র পায়। সঙ্গে পায় রেয়াত জালিয়াতির চিত্র। মামলা, জরিমানা করার পরও ভ্যাট ফাঁকির নিয়মিত চিত্র একই থাকছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এনবিআর সূত্রমতে, গ্যাজেট এন্ড গিয়ার মোবাইল ফোন ও মোবাইল এক্সসরিজ বিক্রির সঠিক হিসাব মূসক রিটার্নে না দেখিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে গোপন তথ্য পায় মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। বিষয়টি যাচাইয়ে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি প্রিভেন্টিভ টিম চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ প্লাজা কনকর্ড টাওয়ারে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গ্যাজেট এন্ড গিয়ারের মোবাইল ফোন ও মোবাইল এক্সেসরিজ বিক্রি ও মূসক-সংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করেন। এতে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে ভ্যাট ফাঁকির আলামত পাওয়া যায়। পরে প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ডেটাবেজ হতে মাসভিত্তিক বিক্রির তথ্য প্রিন্ট করে জব্দ করে নেয় কর্মকর্তারা। জব্দ করা কাগজপত্র গোয়েন্দা কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের মাসিক মূসক রিটার্নের সঙ্গে আড়াআড়ি যাচাই ও পর্যালোচনা করে ব্যাপক গরমিল দেখতে পান। বিশেষ করে ২০১৯ সালের জুলাই হতে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্রির তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে।
অপরদিকে, ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট সূত্রমতে, ২০২১ সালে গ্যাজেট এন্ড গিয়োরের পাঁচটি শো-রুম ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের প্রিভেন্টিভ টিম অভিযান পরিচালনা করেন। ভ্যাট কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় সংক্রান্ত ও ভ্যাট পরিশোধের দলিলাদি জব্দ করেন। প্রতিষ্ঠান প্রতিমাসে যে রিটার্ন দাখিল করে তার সঙ্গে জব্দ করা দলিলাদি যাচাই করে ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পান। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান শো-রুমে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রয় করে, সেই বিক্রয় হিসাব সঠিকভাবে রিটার্নে দেখায় না। মূলত ভ্যাট ফাঁকি দিতেই বিক্রয় গোপন করেন। পরে পৃথক পাঁচটি মামলা করা হয়। ২০২২ সালে পাঁচটি মামলার বিচারাদেশ দেন কমিশনার। যাতে ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় গ্যাজেট এন্ড গিয়ারকে ভ্যাট আইন অনুযায়ী ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা করা হয়।
হিসাব অনুযায়ী, পুলিশ প্লাজা কনকর্ডে প্রতিষ্ঠানের শো-রুমে পণ্য বিক্রয় রিটার্নে গোপন করায় প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার ভ্যাট ফাঁকির মামলা করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান বিক্রির উপর এই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁকি দেয়া এই ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা করা হয়। পুলিশ প্লাজা কনকর্ডে গ্যাজেট এন্ড গিয়ারের প্রধান কার্যালয়। একইভাবে বনানী শো-রুমের জব্দ করা বিক্রয় দলিলাদি ও রিটার্ন যাচাই করে কর্মকর্তারা দেখতে পান, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর বিক্রির উপর প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪ লাখ ৯৯ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা করা হয়। যমুনা ফিউচার পার্কে দুইটি শো-রুম রয়েছে। এর মধ্যে একটি শো-রুমের জব্দ করা বিক্রয় দলিলাদি ও রিটার্ন যাচাই করে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রির উপর প্রায় ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা ফাঁকি পাওয়া যায়। অপর শো-রুমে একইভাবে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রির উপর প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা ফাঁকি পাওয়া যায়। দুইটি শো-রুমে ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা করা হয়। গুলশান এভিনিউ শো-রুমের জব্দ করা দলিলাদি ও রিটার্ন যাচাই করে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকি পাওয়া যায়। পরে ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা করা হয়। পাঁচটি মামলায় ফাঁকি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দেয়া ভ্যাট ও জরিমানা জমা দিয়েছে।
অপরদিকে, ভ্যাট ফাঁকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহারও করেছে গ্যাজেট এন্ড গিয়ার। ২০২১ সালে পাঁচটি শো-রুমের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে কাগজপত্র যাচাই করে ভ্যাট অফিস। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে অবৈধভাবে রেয়াত নিয়েছে মোট ৬৭ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭৯ টাকা। পরে পৃথক চারটি মামলা করা হয়। অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় পৃথক ৪০ হাজার টাকার জরিমানা করা হয়। প্রতিষ্ঠান অবৈধ রেয়াত নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জমা দিয়েছে।
সূত্রমতে, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ারের ঢাকায় ১৯টি শো-রুম রয়েছে। তাদের শো-রুমে আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুক, অ্যাপল ওয়াচ, এয়ারপডস, আইম্যাকসহ অ্যাপলের অনুমোদিত সব যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। এছাড়া ব্র্যান্ডের অন্যান্য মোবাইল ফোন, ফোনের যন্ত্রাংশ শো-রুমে বিক্রি হয়। শো-রুমে মোবাইল ও মোবাইল এক্সেসরিজ পণ্য বেশি পাওয়া যায়। যেমন এক্সেসরিজ পণ্যের মধ্যে সব মোবাইল ফোনের বিশেষ করে অ্যাপল, স্যামসাং, ওয়ান প্লাস, এইচটিসি, গুগল, এলজি, হুয়াহওয়ের ‘কেইস ও স্কিন প্রোটেক্টর’ পাওয়া যায়। এছাড়াও পাওয়ার ব্যাংক, ষ্পিকার, ট্রু ওয়ারলেস, হেডসেট, স্মার্ট ট্রেকার, মাইক্রোফোন, চার্জার ও অ্যাডাপ্টার, ওয়ারলেস চার্জার, কার এক্সেসরিজ যেমন কার মাউন্ট, কার চার্জার, কার পিউরিফায়ার ইত্যাদি। গেজেট এন্ড গিয়ার অ্যাপল এর ম্যাকবুক বা ল্যাপটপের একমাত্র বাংলাদেশি এজেন্ট বা ডিলার। আইফোন, স্যামসাং, ওয়ান প্লাস থেকে সব ধরনের ফোন শো-রুমে পাওয়া যায়। এছাড়া একশান ক্যামেরা, আইপি ক্যামেরা ও সব ধরনের ক্যামেরা এক্সেসরিজ পাওয়া যায়। অ্যাপেল, হুয়াওয়ে, টাইটানসহ বেশিরভাগ স্মার্ট ওয়াচ পাওয়া যায়।
এনবিআর সূত্রমতে, ল্যাপটপ ও ল্যাপটপের যন্ত্রাংশে বিক্রিতে ভ্যাট নেই। মোবাইলের বিক্রয় পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। চলতি অর্থবছর বাজেটে এই ভ্যাট আরোপ করা হয়, যা গ্রাহক থেকে আদায় করা হয়। কিন্তু গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার আদায় করে না। এছাড়া মোবাইলের যন্ত্রাংশ ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের শো-রুমগুলো আদায় করে না।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে গ্যাজেট এন্ড গিয়ারের পার্টনার মোহাম্মদ নুরে আলম খান এর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেয়া হয়। তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। তবে তার নাম্বার এই প্রতিষ্ঠানের পার্টনার মো. আহসান কবীর চৌধুরীর নাম্বারে ‘ডাইভার্ট’ করা রয়েছেন। ফলে নুরে আলম খানকে ফোন দেয়া হলে আহসান কবীর রিসিভ করেন। রিটার্নে বিক্রির সঠিক হিসাব দেখানোর অভিযোগের বিষয়ে মো. আহসান কবীর চৌধুরী বলেন, আমরা ক্রেতা থেকে ভ্যাট পায় না। এনবিআরকে যা দিতে হয়, সেটা নিজে থেকে দিতে হয়। ক্রেতা থেকে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ভ্যাট ক্লেম করতে পারি না। আমার বিক্রয় করা প্রোডাক্ট থেকে দিতে হয়। ওয়ারেন্টি প্রোডাক্ট আমি ছাড়া আর কেউ সেলও করে না। আমার মতো ভ্যাটও কেউ দেয় না। অন্যান্য মোবাইল দোকানে গিয়ে দেখেন পাঁচশ, এক হাজার, দুই হাজার টাকা দেয়। আমি একটা শো-রুমে বিশ, বাইশ, পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ারের সামর্থ্যবানরাই তাদের গ্রাহক। তাহলে ক্রেতা থেকে ভ্যাট নিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে অসুবিধা কোথায়? রিটার্নে প্রোডাক্ট ওয়াইজ বিক্রির হিসাব না দেখালে ফাঁকি রোধ সম্ভব হবে না। ফলে ভ্যাট অফিসকে প্রতিষ্ঠানের আমদানি ও বিক্রির তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শো-রুমে প্রোডাক্ট ওয়াইজ বিক্রির হিসাব রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে একটা বিক্রির তালিকা দিয়ে রেভিনিউ দেয়। ভ্যাট অফিস নজরদারি বৃদ্ধি করলে ফাঁকি রোধ সম্ভব হবে।
অপরদিকে, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ারে অবৈধ হ্যান্ডসেট বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এই প্রতিষ্ঠানের বনানী ও গুলশান অ্যাভিনিউয়ের শো-রুমে অভিযান চালিয়ে নামকরা ব্র্যান্ডের প্রায় চার শতাধিক অবৈধ হ্যান্ডসেট উদ্ধার করা হয়।
***